ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রুশ বিদ্যা আর চীনের প্রযুক্তি, বছর ঘুরতেই কোটিপতি!

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৮
রুশ বিদ্যা আর চীনের প্রযুক্তি, বছর ঘুরতেই কোটিপতি! জব্দ হওয়া বিভিন্ন সরঞ্জামসহ প্রতারক শরিফুল ইসলাম, ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: রাশিয়াতে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে বিদেশি বন্ধুর কাছ থেকে শেখেন কার্ড জালিয়াতির কৌশল। দেশে ফিরে চীন থেকে আমদানি করেন প্রতারণা কাজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এরপর অভিনব পন্থায় গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে অর্থ আত্মসাৎ করে অল্পদিনেই কোটিপতি বনে যান শরিফুল ইসলাম নামের এক যুবক।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ৫টি ব্যাংকের (ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইবিএল ব্যাংক, ইউসিবিএল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া) ভুয়া এটিএম কার্ড ব্যবহার করে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরেও গত ৫ বছর ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এই প্রতারক।

মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় নিজ বাসা থেকে এটিএম কার্ড জালিয়াতির এই মূল হোতাকে গ্রেফতার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কার্ড জালিয়াতির হোতা শরিফুল ইসলাম নিজে পুরোটাই ভুয়া। হাজার হাজার ছদ্মনাম, ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে চাকরি ও বাসা ভাড়া নিতেন তিনি। কিছুদিন পর পরই বাসা পরিবর্তন করতেন। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতারক শরিফুল স্বপ্ন সুপার শপ ছাড়াও আগোরা ও আরেকটি সুপার শপে ‘পজম্যান’ হিসেবে চাকরি করেছেন। সুপার শপগুলোর পজ মেশিনে প্রচুর পরিমাণে কার্ডে লেনদেন হয়। দায়িত্ব পালনকালে তার হাতঘড়ির নিচে ছোট একটি ‘স্কিমিং ডিভাইস’ লাগানো থাকতো। গ্রাহকের কার্ড হাতে নিয়ে সেই ঘড়ির সামনে ধরলেই কার্ডের সকল তথ্য ডিভাইসে সংরক্ষিত হতো। আর গ্রাহক পিন নম্বর চাপার সময় তিনি খেয়াল করে নম্বরটি কাগজে টুকে রাখতেন।

পরে বাসায় গিয়ে সেসব তথ্য ল্যাপটপে ওপেন করে খালি কার্ডে স্থাপন করে ক্লোন কার্ড তৈরি করতেন। খালি কার্ড, স্কিমিং ডিভাইসহ যাবতীয় সব সামগ্রী চীন থেকে আমদানি করেছেন তিনি। সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকার সামগ্রী ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন শরিফুল।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, মাস দুই-এক চাকরি করে গ্রাহকদের তথ্য সরবরাহ করতেন তিনি। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এক ব্যাংকের কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে অর্থ উত্তোলন করতেন। আবার টাকা উঠানোর সময় পরচুলা, চশমা লাগিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। যেন সিসিটিভি ক্যামেরায় আসল চেহারা ধরা না পড়ে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, মেহেরপুরের ছেলে শরিফুল ২০০৭ সালে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য রাশিয়া যান এবং ২০১০ সালে দেশে ফিরে আসেন। রাশিয়ান রুমমেট ইভানোভিচের কাছ থেকে ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার অভিনব কৌশল শেখেন। দেশে ফিরে প্রথমে মানুষজনকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবসা শুরু করলেও ২০১৩ সাল থেকে অভিনব এই প্রতারণা শুরু করেন তিনি।

গত মাসে বনানীর স্বপ্ন সুপারশপে কেনাকাটা করেছেন এমন ৪৯ গ্রাহকের তথ্য নিয়ে নতুন কার্ড তৈরি করে ২০ লাখ টাকা তুলে নেয় একটি চক্র। এরপরই এ ঘটনার তদন্তে নামে সিআইডি।

তথ্য চুরির ঘটনায় গ্রাহকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ কি না জানতে চাইলে স্বপ্নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান লিটন বলেন, আমরা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ না। ওই ছেলেটা কীভাবে এসব করলো সেটা তদন্তের আগে বলাটা কষ্টসাধ্য ছিল। কাস্টমারের অভিযোগ পাওয়ার পর দেখি পজ মেশিনের সামনের ছেলেটা কিছু লিখছে। তখনই তাকে সরাসরি এইচআর ডিপার্টমেন্টে অ্যাটাচ করেছিলাম। এরপর থেকে তাকে আর মোবাইলে পাওয়া যায়নি। তার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গ্রামের বাড়িতে গিয়েও দেখা গেছে ভুয়া ঠিকানা।

বর্তমানে নিয়োগসহ বিভিন্নস্থানে নতুন নিয়মনীতি চালু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ছিল একটা অ্যাক্সিডেন্ট। পজ মেশিনগুলোর উপরে হুডি দিতে ব্যাংকগুলোকে আমরা বলেছি। এছাড়া, সেখানে যে ছেলেটা কাজ করছে, তার শরীরে কোনো ডিভাইস নেই নিশ্চিত করা হয়।

মার্চে ব্র্যাক ব্যাংকের ৯টি কার্ড নকল করে জালিয়াতি করা হয়েছে জানিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমউনিকেশন জারা জাবীন মাহবুব বলেন, গ্রাহকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা খতিয়ে দেখে বুঝলাম জালিয়াতি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছি।

ব্র্যাক ব্যাংকের প্রায় দেড় কোটি প্লাস্টিক কার্ড গ্রাহকের হাতে রয়েছে উল্লেখ করে জারা জাবীন বলেন, বর্তমানে চিপ সংযুক্ত নতুন প্রযুক্তির একটা কার্ড গ্রাহকদের দেওয়া হচ্ছে। যেটা থেকে তথ্য চুরি সম্ভব নয়।

হাতঘড়িতে লুকানো ডিভাইসে এটিএম কার্ডের তথ্যচুরি!

বাংলাদেশ সময়: ২১২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৮
পিএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।