কিন্তু সাড়া না দিয়ে উল্টো ভেতর থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এরপর মুহুর্মুহু গুলি আর বিস্ফোরণের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
শুরু হয় ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে নব্য জেএমবির ‘জঙ্গি আস্তানায়’ শুরু হওয়া অভিযানে যোগ দেয় পুলিশের সোয়াট টিম। অপারেশন ঈগল হান্ট চলে প্রায় ৪০ ঘণ্টা। পরদিন ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় শ্বাসরুদ্ধকর সেই অভিযান শেষ হয়।
অপারেশন ঈগল হান্ট ছিলো উত্তরাঞ্চলের বড় অভিযান এবং স্মরণকালের আলোচিত ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের পর এর আগে এমন বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির শব্দ শোনেননি শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষ। বছর ঘুরলেও তাই সেদিনের ঘটনা স্মৃতিপটে ভাসতেই এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে গ্রামাবাসীর। এমন দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ভুলতে চায় নিহত আবুর পরিবার।
এপ্রিল এসে গেছে। তাই শত আনন্দের মধ্যেও ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে এসেছে সেই শিবপুর-ত্রিমোহনী গ্রামে। এখনও গ্রামে রয়ে গিয়েছে সেই ধ্বংসের স্মৃতিচ্ছবি।
সেদিন যা ঘটেছিল:
আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মতে, হলি আর্টিজান ও সিলেটের শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহলে অভিযানের পর এটি ছিল সবচেয়ে বড় অভিযান। আর এই অভিযানের সফলতা- জীবন্ত উদ্ধার। এই জঙ্গি বাড়ি থেকেই নব্য জেএমবির দুর্ধর্ষ জঙ্গি আবুর তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন এবং তার ছয় বছরের শিশুকন্যা সাঈদাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সক্ষমও হয় সোয়াট টিম।
এ অভিযান পরিচালিত হয় হলি আর্টিজান হামলার সূত্র ধরেই। সোয়াটের অপারেশন চলাকালে সেদিন নিজেদের বোমা বিস্ফোরণে রফিকুল ইসলাম আবু ওরফে আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুসহ চারজন নিহত হয়েছিলেন। নিহত আবু চাচরা গ্রামের আফসার আলীর ছেলে। নিহত অন্য তিনজনের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা য়ায়নি। তবে গত বছরের ২২ জুলাই পরিচয় শনাক্ত হয় অপারেশন ঈগল হান্টে নিহত আরও দুই জঙ্গির। তারা হলেন- বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। তারা উভয়ই হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত নব্য জেএমবির তামিম-সরোয়ার গ্রুপের সদস্য ও শীর্ষ নেতা বলে জানায় আইন-শৃঙাখলা বাহিনী।
বর্তমানে বাড়িটির যে দশা:
ওই গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাইকেলের চেইন দিয়ে বাইরে থেকে তালা দেওয়া রয়েছে নিহত জঙ্গি আবুর সেই ভাড়া করা বিধ্বস্ত বাড়ির মূল ফটক। লোহার গেটের সেই ছিটকিনিতে লাগানো রয়েছে বাড়তি একটি তালা। সাইকেলের চেইন ও লোহার গেটের তালাতে এরই মধ্যে মরিচা ধরে গেছে।
দেখে সহজেই বোঝা যায় অনেক দিন খোলা হয়নি বাড়িটির গেটের তালা। তবে বাইরে থেকে দেয়ালে থাকা সেই দিনের গুলির ক্ষতচিহ্ন এখনও দৃশ্যমান। বাড়ির চারিদিকে লতাপাতা বেয়ে উঠেছে। অনেক দিন কেউ না থাকায় জনমানবহীন বাড়িটি এক কথায় ভুতুরে বাড়িতে রূপ নিয়েছে । এখনও সন্ধ্যার পর কেউ ওই পথ দিয়ে আর হাঁটেন না।
বাড়ি ফেরত চান আনোয়ার:
শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে আমবাগানের মধ্যে একতলা ওই বাড়ির মালিক ৭৫ বছর বয়সী সাইদুর রহমান ওরফে জেন্টু বিশ্বাস। নিজে পরিবার নিয়ে পাশেই আরেকটি বাড়িতে থাকেন তিনি। বাড়িটি তার ছেলে আনোয়ার হোসেনকে দিয়ে দিয়েছেন জেন্টু বিশ্বাস। আনোয়ার হোসেনও সেই বাড়িতে থাকতেন না।
ঘটনার প্রায় তিন মাস আগে চাচরা গ্রামের দিনমজুর রফিকুল আলম আবুকে ভাড়া ছাড়াই ওই বাসায় থাকতে দেন আনোয়ার হোসেন। এক সময় মাদ্রাসায় পড়া আবু একজন মশলা বিক্রেতা ছিলেন। বাড়ি মালিক তাই আবুর জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কথা টের পাননি। অভিযানের পর উদ্ধার তৎপরতা শেষে গত বছরের ২৮ এপ্রিল বাড়িটিতে তালা দেয় পুলিশ। আজও সেই বাড়িটি ফেরত পাননি আনোয়ার হোসেন। থানায় গেলে পুলিশ জানায় তদন্ত শেষ হয়নি। হলে বাড়ি ফেরত দেওয়া হবে। তাই এই মামলার তদন্ত যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে বাড়িটি আবারও ফেরত চান মালিক জেন্টু বিশ্বাসের ছেলে আনোয়ার।
দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ভুলতে চায় আবুর পরিবার:
জঙ্গি আবুর বাবা চাচরা গ্রামের আফসার আলী বলেন, ছেলে জঙ্গিবাদে জড়ানোয় এখনও তাকে নিয়ে ভাবতে ঘৃণা হয়। মৃত্যুর পর তাই ছেলের মরদেহ নেননি। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে পুলিশ। গ্রামের মানুষ ঘটনার পর তাদের মেনে নিয়েছে। তবে প্রতিবেশীদের অনেকে এখনও তাদের বাঁকা চোখে দেখেন। ছেলের জন্য তা মেনে নিয়েই গ্রামে বসবাস করছেন তারা।
তবে সেই দিনের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ভুলে যেতে চান আবুর মা ফুলসানা বেগম। তার শেষ ইচ্ছা আবুর দুই মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করা। আবুর বড় মেয়ে নিশা খাতুন (৯) ও ঘটনার দিন মায়ের সঙ্গে উদ্ধার হওয়া সাঈদা (৭) এখন তার নানী সোনিয়া বেগমের সঙ্গে থাকে। ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় সাঈদার নানা রুহুল আমিনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বর্তমানে তিনি ও তার মেয়ে সুমাইয়া কারাগারে আটক রয়েছেন। কিন্তু আবুর দুই মেয়েকে তাদের কাছে আসতে দেন না তাদের নানী।
আফসার আলীর দাবি বিয়ের পর স্ত্রী সুমাইয়া ও শ্বশুরের প্রলোভনে পড়ে ভুল পথে পা বাড়ায় তার ছেলে আবু। তার আশঙ্কা এখন আবুর দুই মেয়েকে নানার বাড়ি থেকে না নিয়ে আসতে পারলে তারাও এক সময় ভুল পথে চলে যেতে পারে। কিন্তু তাদের দাদার বাড়িতে আসতে দেওয়া হয় না। মাঝে মাঝে এসে কেবল দেখা করে যায়। নিশা ও সাঈদাকে তাদের হেফাজতে রেখেই মানুষ করতে চান বলে জানান তাদের দাদা আফসার আলী।
পুলিশের বক্তব্য
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার টিএম মুজাহিদুল ইসলাম জানান, অপারেশন ঈগল হান্টের মামলাটি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। ওই মামলায় আবুর স্ত্রী সুমাইয়া ও শ্বশুর রুহল আমিনসহ ১৮ জন আসামি এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে সুমাইয়াসহ আরও দুজন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
আরও বেশকয়েকজন আসামিকে খুঁজছে পুলিশ। তাদের গ্রেফতার করা গেলে তদন্ত শেষ করা যাবে। তবে শিগগিরই চাঞ্চল্যকর এই অপারেশনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৮
এসএস/এমজেএফ