ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

রানা প্লাজা ধসে ২০ এতিম কন্যার মা ইয়াসমিন

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৮
রানা প্লাজা ধসে ২০ এতিম কন্যার মা ইয়াসমিন রানা প্লাজা ধসে ২০ এতিম কন্যার মা ইয়াসমিন। ছবি: বাংলানিউজ

পাথালিয়া (সাভার) ঘুরে: এতিম শিশু শাহানা আক্তার (১০)। জন্মস্থান পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার আতাইকুলা গ্রামে। শাহানার পিতা ছিলেন রিকশাচালক শাহিন আলম।

শাহানাকে মায়ের গর্ভে রেখেই না মারা যান তিনি। এরপরেই সুখের সন্ধানে শাহানাকে নিয়ে মা আছমা খাতুন ঢাকায় আসেন।

চাকরি নেন রানা প্লাজায়।

ভাগ্যেরে নির্মম পরিহাস। রানা প্লাজা ধসে নিহন হন আছমা। পৃথিবীতে মা-বাবা দুজনকে হারিয়ে এতিম হয়ে পড়ে শিশু শাহানা। এরপরে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহায়তায় সাভার পাথালিয়ায় আঞ্জুমান আজিজুল ইসলাম বালিকা হোমে (এতিমখানা) ভর্তি হয় শাহানা।

২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই এতিমখানার উদ্বোধন করা হয়। এতিমখানাটিতে বর্তমানে শাহানার মতো বিভিন্ন বয়সের ২০টি এতিম মেয়েশিশু বড় হচ্ছে। ২০টি শিশু হোম সুপার নুরুন্নাহার ইয়াসমিনকে ‘মামনি’ বলে ডাকে। নিজের সন্তানের মতো করে প্রায় চারটি বছর আগলে রেখেছেন ইয়াসমিন। সকালে ঘুম থেকে ওঠানো, লেখা-পড়া করানো থেকে শুরু করে সব বিষয়ে দেখভাল করেন ইয়াসমিন। রানা প্লাজা ধসে ২০ এতিম কন্যা।  ছবি: বাংলানিউজইয়াসমিনের নিজের একটি সন্তান আছে। শুদ্ধ হক ওর নাম। বর্তমানে ইয়াসমিন মনে করেন তার মোট সন্তান ২১টি। এর মধ্যে ২০টি মেয়ে ও একটি ছেলে। সবাই এতিমখানার পাশের নবীন গ্রিন ভিউ মডেল হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আছে এই এতিমখানায়।

সকালে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া, স্কুল, পড়ালেখা সব কিছুই চলে নিয়ম অনুযায়ী। এসব এতিম কন্যার কোনো টাকা পয়সা খরচ হয় না। বিজিএমইএ এবং আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সব খরচ বহন করে। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামেরই একজন সদস্য ইয়াসমিন।

হোম সুপার ইয়াসমিন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এই এতিমখানায় মোট ২০ জন ছাত্রী আছে। নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করানো হয়। রানা প্লাজায় আহত, নিহত ও নিখোঁজ তিন ধরনের শ্রমিকদের বাচ্চা আছে। ওরা সবাই আমাকে মামনি বলে ডাকে। ওরা আমার নিজের সন্তানের মতো। এই এতিমখানার শুরু থেকেই আমি আছি। আমি মনে করি আমার ২০টা মেয়ে একটা ছেলে। রোযা ও কোরবানির ঈদে সব সময় ওদের সঙ্গে থাকি। আজকে চারটি বছর কখনও চোখের আড়াল হতে দেইনি। দেশবাসীকে বলবো আপনারা আমাদের ২০ কন্যা ও এক ছেলের জন্য দোয়া করবেন। ’

এতিমখানাটি নিরিবিলি পরিবেশে গড়ে উঠেছে। সব সময় পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকে শিক্ষার্থীরা। তবে অনেক সময় পিতা-মাতার কথা মনে করে কান্নায় ভেঙেও পড়ে ওরা। আর এমন সময় পিতা-মাতার ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন হোম সুপার ইয়াসমিন। এতিম বাচ্চাদের জন্মদিনে উৎসবের ব্যবস্থা করেন।

সবাই উৎসব আনন্দে এখানে দিন কাটায়। পিতা-মাতাকে ভুলিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন ইয়াসমিন। এই এতিমখানার অন্যতম মেধাবী পাপিয়া আক্তার(১৩)। জন্মস্থান বরিশালের হিজলায়। সে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। মা আনোয়ারা বেগম রানা প্লাজা ধসে নিহত হন। দিনমজুর বাবা ইউনুস মুন্সি গ্রামে থাকেন। এখন এতিমখানায় বেড়ে উঠছে পাপিয়া। তবু মা হারানো পাপিয়ার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। রানা প্লাজা ধসে ২০ এতিম কন্যাদের সঙ্গে ইয়াসমিন।  ছবি: বাংলানিউজপাপিয়া বলে, আমি বড় হয়ে পাইলট হবো। আঞ্জুমান আজিজুল ইসলাম বালিকা হোম আমাকে সহায়তা করলে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। ’

এই এতিমখানা থেকে ওদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা শেষে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এরপরে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করবে সংস্থাটি। এই বালিকাদের উচ্চশিক্ষার পর বিয়ের ব্যবস্থাও করবে সংস্থাটি।

সংস্থাটির আহ্বায়ক এমআই চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ২০ কন্যার উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করবো। আল্লাহর রহমতে আমাদের টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। এই কন্যাদের বিয়ের সময় সাড়ে তিন লাখ টাকা করে ব্যয় করবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। কোনো কন্যা পথে থাকবে না। ২০ কন্যার স্থায়ী ঠিকানা করে দিয়েই আমরা দায়িত্ব শেষ করবো। ’

হোমটি পরিচালনায়  আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে এক লাখ টাকা দিচ্ছে বিজিএমইএ। এছাড়া খাওয়া বাবদ দৈনিক প্রতিটি শিশুর জন্য ১৬৬ টাকা করে ব্যয় করা হচ্ছে। এর পুরোটাই বহন করছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। আঞ্জুমান কর্তৃপক্ষ কন্যাশিশুদের থাকা-খাওয়া চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করছে। সবাই মিলে-মিশে ২০ কন্যার দায়িত্ব নিয়েছে।

বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের তথ্যমতে, প্রায় ৫ হাজার শ্রমিকের পরিবারে ৭০০ শিশু ছিল, যারা বর্তমানে হয় মা বা বাবা অথবা দাদি-নানির কাছে বেড়ে উঠছে। এ সংখ্যা আরও বেশি বলে তাদের ধারণা। এর মধ্যে নানা পর্যায়ে ৩শ শিশুর পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হলেও বাকিদের খোঁজ কেউ রাখেননি।

তবে বিজিএমইএ বলছে, এই  শিশুরা বিজিএমইএর সঙ্গে যোগাযোগ করলে একটা ব্যবস্থা করা হবে। এমনকি রানা প্লাজা ধসে যেসব শিশু এতিম হয়েছে তাদের চাকরির জন্য বিজিএমইইএ’র দরজা খোলা।

এতিম শিশুদের প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন,রানা প্লাজা ধসে  এতিম হওয়া শিশুদের আমরা চাকরি দিয়ে দেবো। যার যে ধরণেরযোগ্যতা সেই অনুযায়ী চাকরি দিতে আমরা সহায়তা করবো। ’

‘এখনও তো অনেক এতিম শিশু সহায়তার আওতায়  আসেনি’ –এই কথার জবাবে তিনি বলেন, পাঁচ বছর পর এসব কথা ভুয়া। আমরা নানাভাবে সকল এতিম শিশুর দায়িত্ব নিয়েছি। তবে এখনও কেউ বাদ পড়ে থাকলে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৮
এমআইএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।