রাতের শিফটের লোকজন বিষয়টি জানতেন না। তারা কাজে এসে যথারীতি ডিউটি করেন সকাল পর্যন্ত।
রুবী সিনিয়র সুইং অপারেটর হিসেবে পঞ্চম তলায় কাজ করতেন। সেদিনও ভবনের পেছন দিকের দক্ষিণ পাশের সিঁড়ির কাছাকাছি তার মেশিনে দাঁড়িয়েছেন। পাশেই ছিলেন লাইন চিফ মোহাম্মদ রফিক। তার মেশিনের ওপরেই ছিল ভিম। রুবীদের ওপরে আরও পাঁচটি তলায় ছিল কারখানা।
রফিককে দেখেই রুবী বলেছিলেন, ‘আর কাম করুম না। এবার সত্যিই চইলা যামু। ’ রফিক বলেন-দুষ্টুমি করো না। কাজ করো। কাজ না করলে সংসার চলবে কি করে। বেতন তো কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে।
রফিকের কথায় আশ্বস্ত হলেও নতুন ভাবনা মাথায় উঁকি দেয় রুবীর। বলেন, ‘ভবন তো কাঁপে, এই ভিমের নিচে কাম করুম না। আচ্ছা, তুমি তাহলে অন্য মেশিনে যাও। আমিই ভিমের নিচে খাঁড়াই। মরলে আমিই মরি। লাইন চিপের এই কথায় তহনই আমি সইরা যাই। আর সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় কইরা ছাদ রফিক সাহেবের ওপরে পড়ে। তার মরদেহটাও আর পাওয়া যায়নি। ’
সেদিন ভবন ধসের কথাগুলো এভাবেই বাংলানিউজকে জানান বগুড়ার শেরপুরের মেয়ে রুবী। বার বার তার চোখ ছলছল করে উঠছিল। কোলের সন্তানকে নিয়ে বারবার তাকাচ্ছিলেন জংলায় ভরে ওঠা রানা প্লাজার পরিত্যক্ত ভূমির দিকে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
একনাগাড়ে বলতে থাকেন, ‘আমার চারপাশেই ১০-১২ জন ছিলেন। আমরা কতা কইছি দুইদিন। হেরপর অন্যদের আর আওয়াজ শুনি নাই। তখন আমিও জ্ঞান হারাই। গলা ছাড়া আমার পুরা শরীর চিপায় পড়ছিল। ওরা কইতো, রুবী তুই যেমন তর মায়েরে দেখতে চাস আমরাও চাই। কিন্তু ওরা কেউই পারে নাই। ছয়দিনের দিন আমারে উদ্ধার করছে। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার গায়ে শার্ট। ’
এখনও ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমাতে হয়। একদিন কাজ করলে শরীর ফুলে ওঠে। তাই কোনো কাজই করতে পারি না। স্বামী আমির হোসেন গার্মেন্টসে কাজ করে ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। তার ওষুধ লাগে চার হাজার টাকার। বছরখানেক আগে কোলজুড়ে এসেছে মেয়ে তাহমিনা। মেয়ের জন্য কিছু খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে ভালো নেই রুবী।
অভিযোগ করেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহায়তা এখনও পায়নি। এ পর্যন্ত ১৫ হাজার করে দুইবারে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন। সরকারের কাছে তার একটাই চাওয়া, যেন প্রতিশ্রুতি পূরণ করে স্থায়ী আয়ের কোনো ব্যবস্থা করে দেয়।
অপরিকল্পিত এবং ভঙ্গুর ভবন ‘রানা প্লাজা’ গার্মেন্টস হিসেবে পরিণত হয় এক মৃত্যুফাঁদে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ধসের ঘটনা ঘটে সাভারের এই ভবনে।
লাইন চিফ রফিক কেন মরার কথা বলেছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে রুবী বলেন, ভবনে ফাটল ধরসে। কাঁইপা কাঁইপা ওডে। যে কুনু সময় ভাইঙ্গা পড়তে পারে, এটা তারা জানতো। তারাও মালিকের চাপেই সবাইরে দিয়া কাজ করাইতো। ’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি আর শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো মানুষগুলো এখনও আসেন এখানে। সহকর্মী, বন্ধু, বান্ধবী, স্বামী, স্ত্রীর স্মৃতিকাতরতা তাদের হয়তো ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতের কোনো খুঁনসুটিতে, নয়তো কোনো আনন্দঘন মুহূর্তে। সারাদিন নিজেরা নানা দুঃখগাঁথা ভাগাভাগি করে আবার ফেরেন যার যার বাড়িতে।
পারভেজের মা পারভীন আক্তার ভবনের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। পারভেজের বয়স তখন চার বছর। স্বামী উজ্জ্বল আর পারভেজকে ঘুমের মধ্যে রেখেই কাজে এসেছিলেন পারভীন। শেষ দেখাটাও হয়নি। উজ্জ্বলও অন্যদের মতোই প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল সারাদিন ছেলে নিয়ে এখানে এসে বসে থাকেন।
ক্ষতিগ্রস্তদের সবার দাবি এখন একটাই। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অর্থ সহায়তা দ্রুত দিলে তারা কিছু একটা করে বাকিটা জীবন চালাতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৮
ইইউডি/আরআর