তখনও সুমির দু’টো হাত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখমণ্ডলে রক্তের ছাপ স্পষ্ট।
সোমবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ ডা. রেজাউল আলম জুয়েল বাংলানিউজকে জানান, শিশুটির বাম হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ডান হাতের অবস্থাও তেমন ভাল না। তালুর চামড়া উঠে গেছে। চামড়া আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তালুর চামড়ার জন্য তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে মাথার আঘাতটা গুরুতর নয়।
তিনি আরও জানান, হাসপাতাল থেকে রক্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাবতীয় ওষুধপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। এরপরও অর্থের প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা চিকিৎসকরা আছি। শিশুটির সুচিকিৎসার জন্য অর্থের কোনো সমস্যা হবে না।
এদিকে শিশু সুমির পরিবারের খোঁজ করতে গিয়ে ওঠে আসে আরও করুণ চিত্র। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ফুলতলা দক্ষিণপাড়া তার গ্রাম। হাদ্দমা নামের একটি পুকুরের পূর্বপাশ ঘেঁষে শিশু সুমির পরিবারের বসবাস।
সরেজমিনে দেখা যায়, টিনের ঘেরা ও ছাউনি বিশিষ্ট একটি বাড়ি। জায়গাটিও নিজেদের নয়, খাস জমি। বাবা দুলাল খা আগে ভ্যান চালাতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কিছুদিন আগে ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঝুপড়ি ঘর তুলে মুদি দোকান দিয়েছেন। সেই দোকানে দিনে বড়জোড় ৩০-৫০ টাকা বেচা-বিক্রি হয়। মা মরিয়ম অন্যত্র কাজ করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেটিও ভালভাবে করতে পারেন না। সংসারে রয়েছে তিন মেয়ে।
সবার শরীর প্রায় হাড্ডিসার। বড় মেয়ে দোলেনার বছর দুয়েক আগে বিয়ে হলেও ‘পাগলে’র মত হাবভাব হওয়ায় বেশি দিন স্বামীর সংসার করা হয়নি। এখন সে ঢাকায় এক বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। তার ছোট সুখিয়া খাতুন (৯)। স্থানীয় একটি স্কুলে মাঝেমধ্যে পড়তে যায়। সে ঠিকমত কথাও বলতে পারে না। সবার ছোট সুমি। আজ সে দুর্ঘটনায় হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে হাসপাতালের বিছানায়।
সুমি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সুখিয়া বাংলানিউজকে বলে, ‘আমার বোন মরে গেছে। তাকে আর দেখতে পাবো না। ও আর আমার সাথে খেলবে না’ এসব বলে চুপ থাকে। বাবা দুলাল খা বাড়িতে ছিলেন না। মা মরিয়ম বেগম হাসপাতালে মেয়ের সঙ্গে রয়েছেন।
সুমির চাচাতো বোন বিথি বাংলানিউজকে বলে, অ্যাকসিডেন্টের সময় আমি স্কুলে ছিলাম। আমার আব্বা এসে বলে সুমির অ্যাকসিডেন্ট হইছে। তোমার বোনের অবস্থা ভাল না। ও হয়তো বাঁচবে না।
শিশু সুমির চাচি জুলেখা বেগম বাংলানিউজকে জানান, ওদের সংসারে খুব অভাব। অনেক সময় না খেয়ে দিন কাটে ওদের। আবার অনেকদিন দু’এক বেলা খায়। তাই কোথাও দাওয়াতের কথা শুনলে ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে কখনও বাবা আবার কখনও মা সেখানে ছুটে যান সামান্য খাবারের আশায়। দাওয়াতের খবর পেয়ে সুমিকে নিয়ে রোববার (২২ এপ্রিল) সেখানেই যাচ্ছিলেন তার বাবা। কিন্তু সড়ক পার হতে গিয়েই ঘটে এ দুর্ঘটনা।
আলতাফুন্নেছা, চায়নাসহ একাধিক প্রতিবেশী বাংলানিউজকে জানান, খেয়ে না খেয়ে চলে ওদের দিন। পাশে থাকা শিশু সুখিয়া খাতুনকে দেখিয়ে বলেন খাওয়ার অভাবে মেয়েটি শরীর প্রায় হাড্ডিসার হয়ে পড়েছে।
রোববার (২২ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের শেরুয়া বটতলা এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শিশু সুমির বাম হাত। এ ঘটনায় সোমবার (২৩ এপ্রিল) সকালে ট্রাকের চালককে অভিযুক্ত করে সুমির চাচা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে এতথ্য নিশ্চিত করেন জানান, ঘাতক ট্রাকের চালক পলাতক রয়েছে। এখনও তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। তবে ধরতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৮
এমবিএইচ/আরএ