ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

একটি সেতুর অভাবে...

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৮
একটি সেতুর অভাবে... দীর্ঘ সাঁকো পার হয়ে বিদ্যালয় থেকে ফিরছে শিক্ষার্থীরা

মৌলভীবাজার: সুলতানা। অসহায় অস্বচ্ছল সংসারে বাবা হারা সুলতানার বিয়ে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন তার চাচা পক্ষাঘাতগ্রস্থ আব্দুল আহাদ মিয়ার। 

নদীর ধারে বসত বাড়ির একটি অংশ বিক্রি করে দেন সুলতানার বিয়ের খরচ যোগাতে। ছেলেমেয়ে দেখা শেষে বিয়ে ঠিক হয়।

আয়োজনও চলছিল ঠিকঠাক কিন্তু বিপত্তি ঘটে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে।  

সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিয়ের মত ফিরিয়ে নেয় বরপক্ষ। হতাশ হয়ে পড়ে সুলতানা ও তার পরিবার। পরে সুনামগঞ্জ জেলায় তার নানা বাড়িতে রেখে তাকে বিয়ে দিতে হয়েছিল।

দশম শ্রেণির ছাত্রী তারিন। পড়ালেখায় প্রবল আগ্রহী তারিনের স্বপ্ন নিজেকে সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তোলা। তাই তো  ৬০০ ফুট লম্বা সাঁকো পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতো সে। প্রতিদিনের মতো গত ৬ মার্চ সকালে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় সাঁকো থেকে নদীতে পড়ে গুরুতর আহত হয় সে। এখন সাঁকো পার হওয়ার ভয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না সে।  

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাজিরবাজার সংলগ্ন মনু নদের ওপর একটি সেতুর  অভাবে মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ চরম      ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। একটি সেতুর অভাবে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সুলতানা কিংবা তারিনের মতো অনেককে। এতে পিছিয়ে পড়ছে এই এলাকার মানুষের জীবনমান। বিশেষ করে ওই তিন উপজেলার ৩৮টি গ্রামের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।  
এলাকার মানুষের দৈনন্দিন নানা কাজে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়।  

জানা যায়, নদীর পূর্ব পারে অবস্থিত মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার পাগড়িয়া, সোনানুয়া, আব্দুল্লাহপুর, মীরপুর, পালপুর, আমওয়া, সুমারাই, চানপুর, কাশিমপুর, মধুপুর, অন্তেহরি, কাদিপুর, জগৎপুর, ইসলামপুর সোনাপুর, ওয়াবদাবাজার, জুম্মাপুর, গালিমপুর, পইলনপুরসহ আরো কয়েকটি গ্রামের অবস্থান । এইসব গ্রামে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার লোকের বসবাস। নদীর দক্ষিণ পাশে অর্থাৎ মৌলভীবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাট-বাজার, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দিরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকায় মনু নদ পার হয়ে কাজিরবাজার দিয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠানে যেতে চরম দুর্ভোগের স্বীকার হন তারা। ওই গ্রামের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত নদী পার হয়ে আপ্তাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, খলিসপুর আলিম মাদ্রাসা, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ ও মহিলা কলেজে যাতায়াত করতে হয়। ওই গ্রামগুলোর মধ্যে বড় কোনো বাজার না থাকার কারণে এলাকার লোকজন প্রতিনিয়ত হাট-বাজার করার জন্য নদী পার হন। ঝুঁকি নিয়ে সাঁকো দিয়ে মালপত্র পারাপার করতে হয় তাদের।  

এছাড়া নদীর পশ্চিম পারে আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে কাজিরবাজার, বেকামুড়া, পাঠানটুলা,  উম্মরপুর, বাউরভাগ, গোলাপগঞ্জ, কর্মচিতা, খালিশপুর, বাসুদেবশ্রী, নাদামপুর, যমুনীয়া,  গোড়াখাল ও শ্রীদরপুর এলাকার লোকজনকে নিয়মিতই মনু নদ অতিক্রম করে উত্তর পাশের সেওয়াইঝুড়ি ও কাউয়াদীঘি হাওরে চাষাবাদ করতে যেতে হয়। বিশেষ করে বোরো ও আমন মৌসুমে ফসল ঘরে তুলতে তাদের সীমাহীন কষ্টের ভোগ করতে হয়।  

স্থানীয়রা জানান, নৌকায় পারাপারের ব্যবস্থা থাকলেও সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ অনেক যাত্রী না এলে নৌকা ছাড়ে না। শুকনো সময়ে পানি শুকিয়ে গেলে নৌকা অচল। বর্ষাকালে রাতের বেলায় নদী পারের জন্য নৌকা মেলে না। তাই দূর-দূরান্ত থেকে বাড়ি ফিরতে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। বর্ষায় নদ থাকে উত্তাল। নৌকায় পার হতে গিয়ে অনেকেই পড়ে যান নদীতে। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের জরুরি চিকিৎসার জন্য যখন তখন শহরে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বেড়ে যায় মৃত্যু ঝুঁকি। এজন্য একটি ব্রিজ চান স্থানীয় জনগণ। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এখানে ব্রিজ নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কেউই পরে আর তা বাস্তবায়ন করেননি। অনেক আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি।

মিরপুর গ্রামের বাসিন্দা বদরুল হাসান জোসেফ বাংলানিউজকে বলেন, গ্রাম পঞ্চায়েতের লোকজন প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পরিবার থেকে বাৎসরিক সর্বনিম্ন তিন হাজার ও সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে নৌকা ও সাঁকোর ব্যবস্থা করেন। যারা একটু অসচ্ছল তারা তিন হাজার করে দেন। আর যাদের অবস্থা ভালো তারা দেন পাঁচ হাজার টাকা।  বর্ষা মৌসুমে দু’টি নৌকা এবং শুকনো মৌসুমে পাশাপাশি দু’টি সাঁকোর ব্যবস্থা করা হয়। বিকল্প রাস্তায় বাড়ি আসতে হলে কামালপুর ইউনিয়নের নয়া ব্রিজ হয়ে পাঁচ/ছয় কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়।  

আপ্তাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবাদুল হক দুলু বাংলানিউজকে বলেন,  একটি সেতুর জন্য হাজারো ছাত্রছাত্রীর ভোগান্তি। শীতে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি মোটামুটি থাকলেও বর্ষায় নদী পারাপারের ভয়ে উপস্থিতি থাকে হাতে গোনা। আবার বর্ষায় উত্তাল নদ পারি দিয়ে ক্লাস নিতে যেতেও ভয় পান শিক্ষকরা।  

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার সদর-রাজনগর আসনের সংসদ সদস্য ও প্যানেল স্পিকার সৈয়দা সায়রা মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, এখানে ব্রিজ নির্মাণের জন্য আমি বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করেছি। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এখানে ব্রিজ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আমি নিজে প্রয়োজনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে কথা বলবো।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৮
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।