ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

‘পাতাবাতা’ উৎসবে রংহীন সাঁওতালপল্লী

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৮
‘পাতাবাতা’ উৎসবে রংহীন সাঁওতালপল্লী ‘পাতাবাতা’ উৎসবে রংহীন সাঁওতালপল্লী। ছবি: বাংলানিউজ

খাগড়াছড়ি: পাহাড়ের অলিগলি আনাচে-কানাচে সবখানে লেগেছে উৎসবের রং। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বর্ণিল সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করছে বৈসাবি উৎসব। এ উপলক্ষে কেনা হয়েছে নতুন কাপড়, সাজানো হয়েছে ঘর। নানা পদের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে অতিথিদের। মেতেছেন উৎসবের আনন্দে।

কিন্তু পাহাড়ে এমন একটি গোষ্ঠী আছে যাদের উৎসবের দিনটিও নিত্যদিনের মত কেটেছে। যেখানে গোটা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ উৎসবে মেতেছিল সেখানে ঠিক উল্টো রথে ছিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ৮০টি সাঁওতাল পরিবার।

তাদের মধ্যে ছিল না উৎসবের কোনো ছোঁয়া। পাহাড়ের একমাত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সাঁওতাল। পানছড়ি ছাড়াও লক্ষ্মীছড়িতেও কিছু সাঁওতাল পরিবার রয়েছে। ‘পাতাবাতা’ উৎসবে রংহীন সাঁওতালপল্লী।  ছবি: বাংলানিউজঅন্য জনগোষ্ঠীর মত তাদেরও রয়েছে বছরের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব। যার নাম পাতাবাহা। বাংলা নববর্ষের দিন থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে বাহামি, পাতা ও ছাতা নামে তিনদিন ধরে এই উৎসব পালিত হয়। কিন্তু যেখানে দু’বেলা আহার যোগার করা দুষ্কর সেখানে উৎসব উদযাপন যেন আকাশ কুসুম স্বপ্ন!

ষাট দশকে কাপ্তাই বাঁধের কারণে কয়েক দফায় উচ্ছেদ হয়ে বর্তমান তাদের ঠাঁই হয় পানছড়ির কানুনগো পাড়াসহ চেঙ্গী নদীর আশপাশের এলাকায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য জাতিগোষ্ঠীর ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেলেও সেই স্রোতে ভাসতে পারেনি নিরীহ সাওতাঁল জনগোষ্ঠী। অসহায় এই গোষ্ঠীর বিগত বছরের মত এবারো তারা ভালো করে উৎসব উদযাপন করতে পারেনি।

পানছড়ির কানুনগোপাড়ার বাসিন্দা মগনু টুডু ও শুক্কু টুডু বাংলানিউজকে জানান, ‘যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে উৎসব উদযাপন করি কিভাবে। প্রতিদিন আমরা দিনমজুরের কাজ করে যা পায় তা দিয়ে কোনোভাবে দু’বেলা আহার হয়। অন্য কিছু নয়। ’

বিশ্বমূর্মূ সপ্তম শ্রেণী ও সাজনী মাদী পড়েছে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। কিন্তু অভাবের কারণে আর পড়া হয়নি। উৎসবের কথা তুলতেই মলিন হয়ে যায় তাদের মুখ।

সাজনী বাংলানিউজকে জানান, ভালো করে খাওয়া জোটে না। সেখানে পাতাবাহা উৎসবের জন্য নতুন কাপড় কিনি কিভাবে! বাবা-মা প্রতিদিন রোজগার করে যা পাই তা দিয়েই কোনোমতে আমাদের সংসার চলে।

স্বপ্না মূর্মু ও ময়নামতি কেচুক জানান, পাতাবাহা আমাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব। অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের মত আমরাও এই উৎসব জাঁকালোভাবে উদযাপন করার কথা ছিল। সন্তানদের নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই এখন পাতাবাহা উৎসবটিও মাঝে মধ্যে আমাদের উৎসব মনেই হয়না।

দুঃখের গল্প এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ বছর ধরে তারা এখানে বসবাস করলে এখনো পর্যন্ত সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধায় পাননি পাহাড়ের একমাত্র পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ পড়া দেনা মূর্মূ আক্ষেপ করে বলেন, ষাট দশকে কাপ্তাই বাঁধের কারণে উচ্ছেদ হই। তারপর আরো কয়েকবার উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে কানুনগোপাড়া এলাকায় ঠাঁই হয়েছে। দীর্ঘ এতো বছর পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা আমরা পায়নি। এমনকি আমরা কেমন আছি সেই খবরটি পর্যন্ত নেওয়ার দরকার মনে করেনি। নিজেদেরকে এখন নিজ দেশ পরবাসী মনে হয়।

সাঁওতালপাড়া যুব কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুজন সাঁওতাল জানান, পাতাবাহা উৎসব নিয়ে বিশেষ কোনো আয়োজন নেই। দিনটি ঘিরে ও বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না। তবে অনেকে দিনটি ঘিরে শুধু পূজা অর্চনা করেছে।

খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা বাংলানিউজকে জানান, সাঁওতালরা কঠিন জীবন সংগ্রাম পার করছেন। সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর মত স্বামর্থটাও আমাদের নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মূল স্রোতে যুক্ত করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৮
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।