ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দায় আছে, তবে দায়িত্ব ছাড়বো না: ছেত্রী

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৮
দায় আছে, তবে দায়িত্ব ছাড়বো না: ছেত্রী ত্রিভুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) রাজ কুমার ছেত্রী/ছবি: জি এম মুজিবুর

নেপাল থেকে: ত্রিভুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস২১১ ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে ৪৯ জনের প্রাণহানি ও ২২ যাত্রী আহত হওয়ার দায় স্বীকার করলেও নিজেদের ভুল নেই বলে মনে করেন সেখানকার জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) রাজ কুমার ছেত্রী।

বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে সেদিনের অভিজ্ঞতা এবং দুর্ঘটনার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। পাঠকদের জন্য আলাচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।


 
বাংলানিউজ: কেমন আছেন?


ছেত্রী: ভালো নেই। মনটা অনেক খারাপ। একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হলো। অনেক কষ্ট পাচ্ছি। কারণ যদি জিজ্ঞেস করেন, তা তো বলতে পারবো না। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি কাজ করছে।  কমিটি দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সত্যতা বের করে আনবে।
 
বাংলানিউজ: এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) থেকে বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল বলে অনেকে বলছেন।
 
ছেত্রী: এমনই যদি বলেন, বলবো- আমি সেদিন টাওয়ারের নিচে ছিলাম। ওখানে মিটিং চলছিল। যেহেতু আমি সরাসরি দুর্ঘটনা দেখিনি, যারা দেখেছেন তাদের জিজ্ঞেস করেছি। এটিসি, পুলিশ, পার্কিং পুলিশ যারা দেখেছেন- তারা বলেছেন, জাহাজ ল্যান্ড করার সময় ভালো পজিশনে ছিল না। ওটা দু’দিকে কিছুটা দুলতে দুলতে নামছিল। আমার এক ভাই ছিলেন প্লেনটিতে, বর্তমানে আহত হয়ে মেডিসিটি হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও আমাকে বললো-যখন ওরা কাঠমান্ডু ভেলি ইন করার পর নর্থ দিকে চলে গেছে, তখন থেকে জাহাজ ওয়াজ ইন নট গুড কনডিশন। তখন থেকেই আমরা প্রায় কাঁদছিলাম। অনেকেই ধারণা করছিলাম, দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।


অনেকের সঙ্গে কথা বলে যেটা জানলাম, জাহাজও খারাপ হতে পারে। কিংবা পাইলট অথবা এটিসি’র ভুলও হতে পারে। তবে সেটা আমি এখন বলবো না।  কিন্তু জাহাজ ল্যান্ড করার যে প্রক্রিয়া, ওই জাহাজ ল্যান্ড করার সময় সে রকম ছিল না সেটা নিশ্চিত।
 
বাংলানিউজ: এ বিমানবন্দরে কীভাবে এয়ারক্রাফট নামে?
 
ছেত্রী: আমাদের কাঠমাণ্ডুর ৯০ শতাংশ ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট দক্ষিণ (রানওয়ে জিরো টু) দিক থেকে নামে। যদি হাওয়া অনুকূলে না থাকে বা অন্য কোনো প্রতিকূল অবস্থা থাকে তবে উত্তর (রানওয়ে টু জিরো) দিকটা বেছে নেওয়া হয়। অন্যথায় দক্ষিণ থেকে নামে। ইউএস-বাংলার ফ্লাইটকেও আমাদের কন্ট্রোলার দক্ষিণ দিক থেকে নামতে বলেছিল। কিন্তু পাইলট সাহেব মানলেন না। বললেন, আমি উত্তর দিক থেকে ল্যান্ড করবো। তারপর কন্ট্রোলার বললো-আপনি পূর্ব দিকে চক্কর দেন। ক্যাপ্টেন চক্কর দিয়েছেন, ইট ওয়াজ গুড। তারপরে চক্কর দিয়ে নর্থ থেকে গিয়ে রাইট সাইটে গেলেন, ওটা কি করলেন! ইস্টে চক্কর দিয়ে রানওয়ের ওপর দিকে ওয়েস্টে চলে গেলেন। ওয়েস্ট থেকে রাইটটার্ন করে নর্থে গিয়ে রানওয়ের ল্যান্ড করার জায়গায় না নেমে বাঁ পাশে নামলেন। তখন দুর্ঘটনা হলো।
 
বাংলানিউজ: উত্তর দিকে থেকে নামলে সমস্যা কি?


ছেত্রী: জিরো টু তেও অনেক সময় ল্যান্ড করা হয়। কিন্তু উত্তর দিকে এয়ারপোর্টের ২০-২৫ নটিক্যাল মাইল দূরে পাহাড় আছে। তাই উত্তর দিকে হিট করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য দক্ষিণ দিক থেকেই সাধারণত ফ্লাইট ল্যান্ড করে। যদিও হিট করার সম্ভাবনা কম।
 

বাংলানিউজ: যে কোনো একটা নির্দেশনা কেন দেওয়া হলো না এটিসি থেকে?
 
ছেত্রী: এটিসি'র মূল কাজ পাইলটকে বাতাসের গতিসহ আবহাওয়া জানানো। পাইলটের এখতিয়ার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তবে দু’পক্ষ একমত হতে পারলে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটতো না।
 
বাংলানিউজ: তদন্তের অগ্রগতি কেমন?
 
ছেত্রী: অগ্রগতি বলতে পারবো না। তবে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে তদন্ত কমিটি। তারা ইতিমধ্যে ফায়ার বিগ্রেডের সঙ্গে কথা বলেছেন, সাইট চেক করেছেন এবং ব্ল্যাক বক্স নিয়ে গেছেন। এটিসি-পাইলটের কথপোকথনের সব ডাটা চেয়েছেন মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) । তাদের অফিস সিভিল এভিয়েশন মিনিস্ট্রিতে। আরো দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
 
বাংলানিউজ: ককপিটের তথ্য উদঘাটনের অগ্রগতি কি?
 
ছেত্রী: যদি এখানে পাওয়া তথ্য নিয়ে কনফিউশন থাকে, তবে কানাডা পাঠানো হবে ককপিট। এখানে যদি ভালো তদন্ত প্রতিবেদন আসে, তবে পাঠানো হবে না। ইল্যাংন্ড থেকে বিশেষজ্ঞরা সাহায্য করতে চেয়েছেন। কানাডার বোম্বাইডার কোম্পানি তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে চেয়েছিল। এখানো পাঠায়নি। ব্ল্যাক বক্সের ওপর তদন্ত এক সপ্তাহের ভেতরেই শুরু হবে।
 
বাংলানিউজ: দুর্ঘটনা নিয়ে সাধারণ নেপালিরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতি রয়েছে, কি বলবেন?
 
ছেত্রী: কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টের বাউন্ডারির মধ্যে ৩০ বছরে এটি তৃতীয় দুর্ঘটনা। আশেপাশে বা ভ্যালিতে কিছু বেশি দু্ঘটনার রেকর্ড আছে। কেননা, আমাদের ল্যান্ডের ৮২ শতাংশ পাহাড়। আবার আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হয়। কখন কুয়াশা, কখন বৃষ্টি বা কখন মেঘ আসবে বলা যায় না। আগে থেকে আঁচ করা কঠিন। সমতলের সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাই এখানে সব প্রকৃতির হাতে।
 
বাংলানিউজ: রিস্ক কমে আসছে না কেন?


ছেত্রী: সাত বছর আগে দুর্ঘটনার যে হার ছিল, তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। তারপরও বেশি হয়, কারণ ওয়েদার ভেরি ডেঞ্জারাস। এখান থেকে যদি ২০-৩০ কিলোমিটার বাইরে যান, সব হিলস। একদম ঠাণ্ডা, মেঘ। এসব ঠেকানো যাবে না। কিছু রিস্ক আছে।
 
বাংলানিউজ: অবকাঠামোর দিক থেকে দুর্বলতা আছে বলে অনেক বলছেন।
 
ছেত্রী: রানওয়ে তো বাড়ানোর জায়গা নেই। ওটা একই থাকবে। তবে লেটেস্ট প্রযুক্তি ইনস্টল করবো। ছয় মাসের ভেতরে ফায়ার কমান্ড ভেহিকল, লার্জ ফোম ট্যান্ডার ভেহিকল আনা হবে।

বাংলানিউজ: অভিযোগ রয়েছে, সময় মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে মৃত্যুর হার কমানো যেত।
 
ছেত্রী: অনেকেই কার্বন মনোঅক্সাইডে মারা গেছেন। ফোমে কার্বন মনোঅক্সাইড হয়। পানি দিলে আগুন বাড়ে। ফোম দিলে ফিনিশ হয়ে যাবে। ফোম ফুল ফেজে দিতে পারলাম না। একদিকে আগুনও নেভাতে হবে, অন্যদিকে মানুষও বাঁচাতে হবে। তাই আগুন নেভানো কঠিন ছিল। ফায়ার ভেহিক্যাল বিল্ডিং থেকে ১৫০ মিটার দক্ষিণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেড় মিনিটে তারা পৌঁছে গেছে। প্রথমে পানি তারপর ফোম দেওয়া হয়েছে।
 
বাংলানিউজ: বিধ্বস্ত প্লেন থেকে হাতাহতদের দ্রুত বের করে আনার দক্ষতা ও প্রযুক্তি সুবিধা ছিল না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
 
ছেত্রী: আমেরিকা বা জাপানে ভালো প্রযুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু প্রযুক্তি তো মানুষই চালাবে, তাইতো? হয়তো আপনি জাহাজ তুলে আনলেন, কিন্তু মানুষগুলোকে দেখতে হবে তো আগে। বিদেশে আমরাও ট্রেনিংয়ে যাই। যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে বেশি মারা গেছে তা আমার মনে হয় না। কারণ যে রকম ফায়ার ছিল, তিন মিনিটে গেছি, প্রথমে ভেবেছি কেউ বাঁচবে না। কিন্তু ২২ জন বেঁচে গেছেন। এজন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
 
বাংলানিউজ: ৬৫০ জনের বেশি মানুষ এ বিমান্দবন্দরে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আপনার বক্তব্য কি?
 
ছেত্রী: ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ এ পর‌্যন্ত বিমানবন্দর ঘিরে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু ভেতরে এটা তৃতীয় দুর্ঘটনা। ১৯৬৫ সালে প্রথম হয়েছিল, ওটা ছোট জাহাজ ছিল। তারপর একটা হলো তখন দুইজন মারা গেছেন। তারপর এবারেরটা বড় হলো। আশেপাশের মধ্যে থাই এয়ার একটা, পাকিস্তান এয়ারের দুর্ঘটনা ছিল বড়। ছোট ছোট আরো হয়েছে।
 
বাংলানিউজ: শুধুই কি আবহাওয়ার জন্য এ সব দুর্ঘটনা ঘটছে?
 
ছেত্রী: না না ওটা দেখেন, আমি আপনাকে বলেছি, সমতলে ল্যান্ড করা আর কাঠমান্ডুতে ল্যান্ড করা অথবা নেপালের সমতলে ল্যান্ড করা এক নয়।  সানরাইজ হয়, পানি পড়ে, মেঘ হয়, ইটস কোয়াইট ডিফিকাল্ট। সেজন্য একটু রিস্ক আছে।
 
বাংলানিউজ: এটিসি কোনো দুর্বলতা নেই?
 
ছেত্রী: দক্ষতার অভাব নেই। ট্রেনিং হয়। রিফ্রেশ ট্রেনিং হয়। প্রতি দুই বছর পরপর বিদেশ ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়।
 
বাংলানিউজ: যন্ত্রপাতি কতবছরে পুরনো?


ছেত্রী: আমাদের একটি পত্রিকায় যে নিউজ এসেছিল, তা খণ্ডন করেছি। আমরা বলেছি সব মিথ্যা। আমেরিকার টাওয়ারে, জাপানের টাওয়ারে যে যন্ত্রপাতি আছে, তার থেকে হয়তো একটা, দুইটা যন্ত্রপাতি আমাদের কম আছে। কিন্তু সার্ক, এশিয়ার দেশগুলোতে যে ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সব আমাদের আছে।
 
বাংলানিউজ: এটিসিতে নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে সমন্বয়হীনতা ছিল কি?
 
ছেত্রী: আমাদের টাওয়ারে তিনজন থাকেন। একজন একটিভ কন্ট্রোলার, একজন কো-অর্ডিনেটর। একজন থাকেন গ্রাউন্ড কন্ট্রোলার। জাহাজ গ্রাউন্ডে এলে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলার কাজ করেন। একটিভ কন্ট্রোলার জাহাজ ওপরে থাকলে কাজ করেন। আর দুই কন্ট্রোলারের মধ্যে করঅর্ডিনেটর সমন্বয় করেন। দুর্ঘটনা ঘটার সময় ডিসকাস করেছেন তারা। অডিওতে আমরা তা শুনেছি।
 
ডিসকাস মিনস তখন অ্যাবনরমাল পরিস্থিতি ছিল। তাই আলোচনা করে পাইলটের যেখানে ইচ্ছা সেখানে ল্যান্ড করার কথা বলা হয়েছিল। কেননা, লাস্ট ডিসিশন পাইলটের। এটিসির নির্দেশনা যে মানতেই হবে তেমন কোনো কথা নেই। তবে নামার পর লিখিত জিজ্ঞেস করা যায়, কেন নির্দেশ মানলেন না। কিন্তু এটিসি কখনো বলতে পারবে না- আপনাকে নির্দেশিত রানওয়েতেই নামতে হবে। কেননা, পাইলটের হাতে তো অনেকগুলো যাত্রীর জীবন। তাই তার ওপরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার থাকে।
 
বাংলানিউজ: যার দোষই হোক, এ বিমানবন্দরের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায় নিচ্ছেন কি?

ছেত্রী: দায় তো নিতেই হবে। এখন কে পে করবে, কীভাবে করবে, সে প্রক্রিয়ায় ফেসিলেটর হিসেবে কাজ করবো। আমাদের এয়ারপোর্টে হয়েছে, যদিও আমাদের ভুল নেই। তবে হিউম্যান বিং হিসেবে দায়িত্ব আছে আমাদের। মারা গেছেন তো অনেকে। ওই জন্য দায়িত্ব আছে।
 
বাংলানিউজ: হিউম্যান বিং হিসেবে নয়, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে জিএম কি দায় নেবে?

ছেত্রী: দেখেন একটা কথা বলি। …উম, ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের ভুল না হলেও মারা গেছেন তো। দায়িত্ব নিয়ে হিউম্যান বেসিসে করার আছে। কিন্তু ওই দায়িত্ব নিয়ে পদ ছাড়বো, তাতো নয়।
 
বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ছেত্রী: আপনাকেও ধন্যবাদ
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৪৩৭, ২০১৮
ইইউডি/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad