ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শনাক্ত হয়নি নাজিয়ার মরদেহ, ‘হেলথ চেক আপ’ ফাইলই ভরসা

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৮
শনাক্ত হয়নি নাজিয়ার মরদেহ, ‘হেলথ চেক আপ’ ফাইলই ভরসা নাজিয়া আফরিন/ফাইল ছবি

ঢাকা: নেপালে ইউএস-বাংলার বিএস২১১ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হওয়ার ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা নাজিয়া আফরিন চৌধুরী একজন। নিহত ২৬ জনের মধ্যে শনিবার (১৭ মার্চ) বিকেল পর্যন্ত ১৫ বাংলাদেশির মরদেহ শনাক্ত করা গেলেও নাজিয়া আফরিনের মরদেহ এখনো শনাক্ত হয়নি।

নাজিয়া আফরিন চৌধুরী এ বছরের জানুয়ারিতে কলকাতা ভ্রমণে গিয়েছিলেন বড় বোন মিলি চৌধুরীর সঙ্গে। ১১ জানুয়ারি কলকাতা অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে হেলথ চেক আপ করিয়েছিলেন।

শরীরে কোনো রোগ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করতেই এই পরীক্ষা করিয়েছিলেন নাজিয়া।
 
অথচ দুই মাস পরেই সেই হেলথ চেক আপের ফাইল এখন ব্যবহার হচ্ছে নাজিয়া আফরিনের মরদেহ শনাক্তে। নেপালে প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত নাজিয়া আফরিনের সেই হেলথ চেক আপের ফাইল স্ক্যান করে নেপালে পাঠানো হয়েছে ১৪ মার্চ। তার মরদেহ শনাক্তে চেক আপ ফাইল থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। এজন্য চেক আপ ফাইল নেপাল পাঠানো হয়েছে।  

মিলি চৌধুরী বলেন, নাজিয়া ও আমার শরীরে কোনো রোগ বালাই আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করানোর জন্যই কলকাতা থেকে হেলথ চেক আপ করিয়েছি। অথচ সেই হেলথ চেক আপের ফাইল বোনোর মরদেহ শনাক্তে ব্যবহার করা হচ্ছে। কে জানে আল্লাহ হয়তো এ জন্যই আমার বোনের হেলথ চেক আপ করিয়েছিলো। আমরা নাজিয়ার হাইট জানতাম না, ওর দাঁত ও বুকের এক্সরে ছিল না। অথচ নেপাল থেকে মরদেহ নিয়ে আসতে এগুলো লাগছে। মরদেহ আনতে ১৩ মার্চ নাজিয়ার স্বামী মনিরুল হাসান নেপাল গেছেন। সেখানে তাকে ১৭ পৃষ্ঠার একটা ফর্ম দেয়া হয়েছে। এই ফর্মটা পূরণ করতে হেলথ চেক ফাইল লাগছে। নাজিয়া যেদিন নেপালে যাবে তার একদিন আগে হেলথ চেক আপের ফাইল কাকতালীয়ভাবে বিছানার পাশে রেখে যায়।

শুক্রবাদ সোবহানবাগের ১৪ নম্বর রোডের ৮/এ/১০ নম্বরের বাসায় শনিবার (১৭ মার্চ) কথাগুলো কান্না জড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলছিলেন মিলি চৌধুরী।
 
দশ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট নাজিয়া। আদর করে সবাই নাজিয়াকে জিনু বলে ডাকতো। অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন নাজিয়া।

নাজিয়া আফরিন ১৯৭০ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। হাটখোলার কামরুন নেসা থেকে স্কুলজীবন শেষ করেন নাজিয়া। ১৯৮৮ সালে বদরুননেসা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। সব সময় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করতেন নাজিয়া। ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুগোল বিভাগে স্নাতক ও ১৯৯২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০তম ব্যাচে বিসিএস এ ইকোনোমিক ক্যাডারে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) উপ-প্রধান হিসেবে নাজিয়া আফরিন চৌধুরী কর্মরত ছিলেন।
 
চোখ মুছতে মুছতে বোনের কথা বলেই যাচ্ছিলেন মিলি চৌধুরী। এর ক্ষণে ক্ষণে নিজের অজান্তেই বের হচ্ছিল দীর্ঘশ্বাস। এ দীর্ঘশ্বাস স্বজন হারানোর বেদানায় আরও ভারী হয়ে উঠছে সোবহানবাগেরর ওই বাসা।  

বলছিলেন- নাজিয়া আফরিন মানেই কাজ পাগল একজন মানুষ। সবসময় বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আন্তর্জাতিক যে কোনো সেমিনারের বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ প্রস্তুত করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের ওপর অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। ফলে জলবায়ুগত যে কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিলো নাজিয়া আফরিনের।
 
‘ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস অ্যান্ড প্রোভার্টি অ্যালিভেশন ইন সাউথ এশিয়া প্রাকটিক্যাল অ্যাপ্রোচ টু ইম্প্রুভিং হিউম্যান অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ এর উপর দু’দিনব্যাপী সম্মেলন হবে নেপালের কাঠমান্ডুতে। সম্মেলনে নাজিয়া-সালমার নাম প্রস্তাব করা হয়। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি।

নেপালে যেতে রাজি ছিলেন না রাজিয়া। নানা ধরনের ঝামেলা তৈরি হয়েছিলো নেপাল যাওয়ার বিষয়ে। যেদিন নেপালে যাবেন সেই দিন সকালে জিও (সরকারি আদেশ) হয়েছিলো। অথচ এসব সরকারি কাজে কয়েকদিন আগে সাধারণত জিও হয়।
 
এ প্রসঙ্গে নাজিয়া আফরিনের আরেক বড় বোন সাইদা রেজা শেলি চৌধুরী বলেন, জ্বরের কারণে জিনুর (নাজিয়া) শরীর ভালো ছিল না। জিনু নেপালে যেতে চাচ্ছিল না। জিনু আমাকে নেপালে যাওয়ার দিনে ফোনে বলে আপু দোয়া করো আজকে যেনো জিও না হয়। জিনু আমেরিকা-ইউরোপসহ ১৭টা দেশে গেছে, কখনো মন খারাপ ছিল না। কিন্তু নেপালে জিনু কিছুতেই যেতে চাচ্ছিল না। ’
 
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখন একটাই চাওয়া জিনুর সঠিক মরদেহটা যেন আমরা পাই, আর কোনো চাওয়া নাই। জিনুর সঠিক মরদেহ পেতে আমরা ওর হেলথ চেক আপের ফাইলও নেপালে পাঠিয়েছি। ’

নাজিয়া ছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনের আরেক কর্মকর্তা উম্মে সালমাও গিয়েছিলেন সেই ফ্লাইটে। তারও একই পরিণতি হয়েছে। শনিবার উম্মে সালমার মরদেহ শনাক্ত হয় নি।

শনাক্ত করা মরদেহগুলো হলো- বিলকিস আরা, আখতারা বেগম, মো. রকিবুল হাসান, মো. হাসান ইমাম, মিনহাজ বিন নাসির, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, মো. মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহারা তানভীন শশী রেজা, অনিরুদ্ধ জামান, রফিক উজ জামান এবং পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ ও খাজা সাইফুল্লাহ।  

গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার একটি বিমান বিধ্বস্ত হলে ৭১ আরোহীর মধ্যে ৪৯ জন মারা যান। এর মধ্যে চার ক্রুসহ ২৬ জন ছিলেন বাংলাদেশি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৮
এমআইএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।