ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

‘আমাকে মেরে বেহেশতে যেতে চেয়েছে’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮
‘আমাকে মেরে বেহেশতে যেতে চেয়েছে’ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সিলেট: আমাকে মেরে যুবকটি বেহেশতে যেতে চেয়েছিলো বলে মন্তব্য করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

দুর্বৃত্তের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসা শেষে বুধবার (১৪ মার্চ) নিজ ক্যাম্পাসে ফিরে শাবিপ্রবি’র মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। এদিন মুক্তমঞ্চে ‘সাদাসিধে কথা’ শিরোনামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

ঘাতকের উদ্দেশে বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, তোমাকে যে মারতে পাঠিয়েছে, তার ছেলে-মেয়েরা হয়তো লেখাপড়া করছে। আর তোমার অবস্থা কী? দেখো বাবা-মা ও স্বজনরা রিমান্ডে।  

হামলাকারীর বিরুদ্ধে নিজের মধ্যে কোনো রাগ নেই উল্লেখ করে ড. জাফর ইকবাল বলেন, পত্রপত্রিকায় দেখেছি, ছেলেটি (ফয়জুল) আমাকে মারতে এক বছর ধরে চেষ্টা করছে। পুলিশ প্রশাসনের জন্য পারেনি। তার জন্য মায়া আছে, করুণা আছে, একটা মানুষ কি পরিমাণ দুঃখী হলে ভাবতে পারে যে, আরেকজনকে খুন করে সে বেহেশতে যাবে। এটা কী সম্ভব? অথচ পৃথিবীটা কতো সুন্দর। সে মনে করে ওই মানুষকে মারতে পারলে আমি বেহেশতে যাবো। এখানেই হয়তো তেমন কেউ আছে।

তিনি আরো বলেন, হামলাকারীর দলের কেউ হয়তো এখানে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। তাদের বলি, তোমাদের কোনো কিছু জানা, বোঝার থাকলে আমার সঙ্গে দেখা করো। আমি স্বানন্দ্যে শুনবো। আমি কোরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি।  

কোরআনের উদ্বৃতি দিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, একজন মানুষকে যে হত্যা করে, সে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করে। আর একজন মানুষ যে বাঁচায়, সে পুরো মানবজাতিকে বাঁচায়।

শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে তাদের প্রিয় শিক্ষক বলেন, আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না, এই ক্যাম্পাসে থাকবো। শিক্ষার্থীদের ঋণের বাঁধন কোনো কিছুতে শোধ করার নয়।

প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের বলেন, ‘আমি যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ধন্যবাদ জানাতে না পারছিলাম, ততক্ষণ শান্তি পাচ্ছিলাম না। এখন ভালো লাগছে যে আমি দ্বায়িত্ব পালন করেছি।  

বিভিন্ন সময় জঙ্গি হামলায় নিহতদের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, অভিজিৎ, আমার ছাত্র। অনন্ত, ওয়াশিকুর, নীলয়, হুমায়ুন আজাদ স্যারসহ অনেকের কথাই মনে পড়ছে। আমার শুধু তাদের ও তাদের পরিবারের কথাই মনে পড়েছে। তাদের প্রতি আমি সম্মান জানাই।  

২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগের হামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, উপাচার্য ভবনের সামনে আমাদের ছাত্ররা আমার শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে। তখনই ভেবেছিলাম চলে যাবো, কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টাই। বললাম যে না, কয়েক বছর মাত্র, সহ্য করি, এরপর চলে যাবো (চাকরি শেষে)। ওই ঘটনার পর নিজেকে গুটিয়ে ফেলি।  
 
নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতেন না উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, আমার সঙ্গে যারা সেলফি তুলে তারা আমার জন্য থ্রেট নয় বরং তারাই আমাকে ভালোবাসে। তারা আমাকে সেভ করেছে। আহত হওয়ার পর একটি ছেলে পরনের শার্ট খুলে আমার মাথায় বেঁধে দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেছে।  

আহত হওয়ার পরক্ষণের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, মুক্তমঞ্চে ঠিক এ জায়গাটিতে আমাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। তখন আমি বুঝেছি কেউ একজন ঢিল মারছে। মেয়েরা চিৎকার করছে। আমি তাদের বিচলিত হতে না করেছি। বলছি আমার কিছু হয়নি। হাত দিয়ে দেখি রক্ত বেরোচ্ছে। এর দু’মিনিটের মধ্যেই আমার ছাত্রছাত্রী ও পুলিশ সদস্যরা আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমি ভাবছিলাম আমার ব্রেনের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা। স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করতে চেষ্টা চালিয়েছি।  

চিকিৎসকদের বলেছি, যাতে আমাকে জেনারেল এনেস্তেসিয়া না দেন। কেননা, আমি একটু ভীত মানুষ। ভাবছিলাম জেনারেল এনেস্তেসিয়া দিলে হয়তো ওখান থেকে আর ফিরে আসবো না। খোদা আমাকে আবারো কিছু করার সুযোগ দিয়েছেন।  

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পুলিশ, প্রশাসন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সবাইকে ধন্যবাদ জানান। কোনো এক ফাঁকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জানিয়ে আসবেন-বলেন জাফর ইকবাল।  

অনুষ্ঠানে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছেন। এটাই ছিলো আমাদের চাওয়া।  
 
অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক বলেন, জাফর ইকবাল অন্তত দু’শ বই লিখেছেন। কোথাও ইসলামের বিরুদ্ধে কখনো কিছু লিখেননি। মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সত্য কথা বলার জন্য তাকে থামাতে চেষ্টা চালানো হয়েছে।  

এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার প্রফেসর ড. ইলিয়াস উদ্দিনসহ বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা বক্তব্য রাখেন।
 
এর আগে বেলা ১২টা ৫৮ মিনিটে নভোএয়ারের একটি ফ্লাইটযোগে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে সস্ত্রীক এসে পৌঁছান জাফর ইকবাল। সেখান থেকে পুলিশি পাহারায় আসেন ক্যাম্পাসে নিজ আবাসে। বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে ছাত্রীরা সাইকেল র‌্যালি দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে বাসা থেকে মুক্তমঞ্চে নিয়ে যান। সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চে মতবিনিময় শেষে ক্যাম্পাসে নিজের স্বপ্নের স্থান আইসিটি ভবনে যান।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮/আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা
এনইউ/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।