ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সব হারানো মায়ের আকুতি ‘মরলেই বাঁচি!’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৮
সব হারানো মায়ের আকুতি ‘মরলেই বাঁচি!’ রুনু বেগমের মতো এমন অনেক ছিন্নমূল রয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন পার্কে-ছবি- ডি এইচ বাদল

ঢাকা: ‘স্বামী নাই, সংসার নাই, পোলা-মাইয়া থাইকাও নাই, এহন ঢাকা শহরে ঘুরি। রাইত হইলে পার্কে ঘুমাই। দিন হইলে আবার কাজে যাই।’
 

রোববার (১৪ জানুয়ারি) রাজধানীর গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চ সংলগ্ন পার্কে কথাগুলো বলছিলেন স্বামী, সংসার হারানো ‘মা’ রুনু বেগম।
 
প্রচণ্ড শীতে জবুথবু হয়ে পার্কের উত্তর-পশ্চিম কোণে একা বসে গুনগুন করে কি যেন বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এ শুভ্রকেশী বিধবা।


 
কী করেন? কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘করোনের তো কিছুই নাই, আবার বইয়াও থাকোন যায় না। ’
 
নাম জানতে চাইলে সহজ-সরল উত্তর, ‘গ্রামে থাকতে নাম ছিলো রুনু বেগম, ঢাকায় আইয়া হইছে ‘রুমা’, আর মরণের পর হইবো ‘লাশ’।
 
গ্রাম কোথায়? বলতেই নিজের ‘রুনু’ থেকে ‘রুমা’ হওয়ার গল্প বলতে শুরু করেন রুনু বেগম। বিয়ের পরেও বরিশালের ঝালকাঠিতে বাবার বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই স্বামীর সঙ্গে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে ভালোই ছিলেন রুনু। তবে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর রুনুদের বাড়ি থেকে নেমে যেতে চাপ দেন তার চাচারা (বাবার খালাতো ভাই)। এরপর স্বামীর মৃত্যু হলে তাদের অত্যাচারে আর ওই বাড়িতে থাকা হয়নি। তবে এর আগে রুনু দুই ছেলে ও মেয়ের বিয়ে দেন। ছেলেরা তাদের শ্বশুরবাড়িতে থাকে। আর ছোট মেয়ে গ্রামেই ঘর সংসার করছে। তবে তাদের কারো বাড়িতেই থাকার জায়গা হয়নি রুনুর।
 
চ‍াচারা বাড়ি থেকে কেন বের করে দিলো জানতে চাইলে রুনু বলেন, বাবা বেঁচে থাকতে তার মামার কাছ থেকে জমি কিনে নিয়েছিলো। মামারা অনেক ভালোবাসতো এজন্য দলিল করেনি। এখন তার খালাতো ভাইয়েরা জমির মালিকানা দাবি করে আমাকে বের করে দিয়েছে।
 
এরপর থেকে থাকার নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই রুনুর। দুই ছেলে শ্বশুরবাড়ি থাকায় সেখানেও না থাকতে পেরে চলে আসেন ঢাকা শহরে।
 
ঢাকায় এসে কিছুদিন বড় মেয়ের সংসারে তাদের সিটি কলোনির বাসায় থাকতেন। বড় মেয়ের স্বামী গুলিস্থানে খেজুর পাতার ফুল বানিয়ে বিক্রি করেন। তার সংসারেও টানাপোড়েন।
 
এদিকে কয়েকদিন আগে তার বড় মেয়ের সিজারে একটি সন্তান হয়েছে। এতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ওই টাকা পুরোটাই রুনুর কাছে দাবি করেছেন মেয়ের জামাই। কিন্তু রুনু এতো টাকা দিতে না পারায় সংসারে ঝামেলা লেগেই থাকে। মেয়ের সংসারে ঝামেলা সইতে না পেরে গত কয়েকদিন আগে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন রুনু। সেদিন থেকেই থাকেন এই পার্কে। এখানে সবাই নাম দিয়েছেন রুমা।
 
কিন্তু কিছুদিন পরেই তো সিটি কর্পোরেশন পার্ক থেকে সবাইকে বের করে দেবে। তখন কোথায় যাবেন?
 
উত্তর, ‘যামু আর কই। যেদিক মন চায় যামু। আর ওরা আমার নাম দিছে রুমা। কইছে আগের সব ভুইলা নতুন কইরা বাঁচ। এহন মরলেই বাঁচি’।
 
এদিকে রোববার (১৪ জানুয়ারি) সরেজমিন পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, এমন শতাধিক ছিন্নমূল মানুষ কেউ সংসার নিয়ে আবার কেউ সব হারিয়ে গুলিস্থানের এ পার্কে অবস্থান করছেন।
 
বসতবাড়ি নদী ভাঙনে বিলিন হওয়ার পর পটুয়াখালী থেকে মান্নান এসে থাকেন এ পার্কে। মান্নান ঢাকায় এসে ঢালাইয়ের কাজ করতেন। একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে ডান হাতের গোড়া দিয়ে রড ঢুকে যায় এবং কোমর ভেঙে যায়। এরপর থেকে আর কাজ করতে পারেন না।
 
মান্নানের স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছেন। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে নানির কাছে থেকে পড়ালেখা করে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই ছেলের খরচ মান্নান মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে যোগান। আর বড় ছেলে বিয়ে করে চাঁদপুরে থাকে।
 
কয়েকদিনের মধ্যেই এসব মানুষকে পার্ক থেকে বের করে দেবে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। পার্কের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে, শেষ হলেই বের হতে হবে তাদেরকে। তখন হয়তো রাজধানীর অন্য কোথাও থাকার জায়গা খুঁজবেন এসব ছিন্নমূল মানুষ।
 
স্থানীয় ব্যবসায়ী জসিম বাংলানিউজকে বলেন, সরকার রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। তাদের জন্য একটা চর দিয়ে দিচ্ছে, এসব ছিন্নমূল মানুষের কোনো ব্যবস্থা করতে পারে না? এরা তো আমাদের দেশেরই নাগরিক।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৭
এসআইজে/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।