নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিন-রাতের অমানুষিক পরিশ্রমে সেই সন্তানদের পরম মমতায় আগলে রাখছেন তিনি। স্বামীর প্রতিষ্ঠা করা ও নিজের হাতে গড়ে তোলা অনাথ আশ্রমের ওই শতাধিক ছেলে-মেয়ের কাছেও পরম নির্ভরতার আশ্রয়স্থল মা নিশা দেবী।
এই মায়ের আদর-যত্নেই স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে নিজেদের ভবিষ্যত জীবন গড়ে নিচ্ছে সন্তানেরা। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও ধর্মচর্চাসহ কৌশলগত বিভিন্ন হাতের কাজেও দীক্ষিত হচ্ছে।
অভাব-অনটন, স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কের টানাপড়েন বা নিজের সুখের জন্য যেসব সন্তানকে ত্যাগ করেছেন মা-বাবা, তাদেরকে মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নেন নিশা দেবী। আশ্রমে নিয়ে এসে বহন করেন পরিবার, আপনজন ও অভিভাবক হারিয়ে অনিশ্চয়তার জীবনে পড়ে যাওয়া এসব ছেলে-মেয়ের সমস্ত ব্যয়ভার।
সরেজমিনে গেলে নিশা বাংলানিউজকে জানান, সাধুপুরুষ নিত্যানন্দ গোস্বামী নয়ন ১৯৯৫ সালে চণ্ডিগড়ে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই তিনিও আশ্রমের সদস্য। পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঁচজন অনাথ ছেলে-মেয়েকে আশ্রমে নিয়ে এসে তাদেরকে লালন-পালন করতে থাকেন তিনি। লেখাপড়া করতে স্কুলেও পাঠান।
ধীরে ধীরে আশ্রমে অনাথ শিশু বাড়তে থাকে। আর এখন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অনাথ কিংবা গরিব অসহায় শিশুদের সন্ধান পেলেই আশ্রমে পাঠিয়ে দেন।
আশ্রম প্রধান সাধুপুরুষ নিত্যানন্দ গোস্বামী নয়নকে যেকোনো টানাপড়েনে টিকে থাকতে মানসিকভাবে শক্তি দিয়েছেন নিশা। অনাথ সন্তানদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পূরণে ২০০১ সালে নয়নের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ২০০৬ ও ২০০৯ সালে তাদের দুই ছেলে সন্তান সাগর ও সৈকতের জন্ম হয়।
নয়ন-নিশা দম্পতির ঔরসজাত সন্তানরাও এখন শতাধিক অনাথের সঙ্গে আপন ভাই-বোনের মতোই বেড়ে উঠছে হাসি-আনন্দে।
বর্তমানে অনাথালয়টিতে ১১২ জন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তারা সম্পূর্ণ বিনা খরচে এখানে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনা করে। অনাথদের প্রত্যেকেই দুর্গাপুরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।
প্রতিষ্ঠাতা নয়ন গোস্বামী অর্থের যোগান দিলেও মায়ের মমতায় সারাক্ষণ সন্তানদের আগলে রাখেন তার স্ত্রী নিশা। তাদের নাওয়া-খাওয়া, পড়ালেখা, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ও ধর্ম চর্চা নিয়ে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন।
মমতাময়ী শতাধিক সন্তানের মা নিশা দুর্গাপুরের কানিয়াল গ্রামে ১৯৬৪ সালে জন্ম নেন। তিনি গোপাল বৈষ্ণব ও বাসন্তী বৈষ্ণবের মেয়ে। জন্মের বছর ব্যবধানে মা ও বাবা দু’জনকেই হারিয়ে নিজেও আজন্ম অনাথ এই মমতাময়ী।
নিশা বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্কুলজীবন থেকেই সুবিধাবঞ্চিত ও অনাথদের জন্য মন কাঁদতো। কিন্তু নিজেও সচ্ছল পরিবারের না হওয়ায় তাদের জন্য আশানুরূপ কিছু করতে পারতাম না। তবে সে ইচ্ছায় ভাটা পড়েনি কখনো। সুদিনের আশায় ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি। সে প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছেন ইশ্বর। না হলে এতোজন অনাথ সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে পারতাম না’।
এই শিশু-কিশোরদেরকে নিয়ে জীবন পার করার আশা জানিয়ে নিশা বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওদের মাঝেই আনন্দ খুঁজে পেয়েছি। নিষ্পাপ অবুঝ ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের আলতো স্পর্শ আর সারাক্ষণ মা ডাক শুনতে পেরে কোনো অপূর্ণতা নেই আমার জীবনে’।
নিশা জানান, প্রথমদিকে আশ্রমের ভেতরে কৃষিকাজ, পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন করে খরচ চলতো। লোকসংখ্যা বাড়ার পর সমাজসেবা কার্যালয় থেকে যৎসামান্য কিছু অনুদান যোগ হয়। সামাজিক ও আর্থিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার পরও হাল ছাড়েননি তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৭
এএসআর