ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রেহানার পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি ঘুরে এলেন মাজেদা

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
রেহানার পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি ঘুরে এলেন মাজেদা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

ঢাকা: পাসপোর্ট একজনের নামে। অথচ সেই পাসপোর্ট দেখিয়ে অন্যজন গেছেন বিদেশে! আবার দিব্যি ঘুরেও এসেছেন! তবে বিপত্তি বেধেছে ফেরা নিয়েই। ইমিগ্রেশন বিভাগের সিস্টেম থেকেই আগমনী যাত্রীর চেহারা আর পাসপোর্টের তথ্যে গড়মিল পাওয়ায় বেরিয়ে আসে এই জালিয়াতির ঘটনা।

এ নিয়ে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যেই তোলপাড় শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে। দায়ী কে? তা নিয়েই চলছে আন্তঃসংস্থাগুলোর মধ্যে চিঠি চালাচালি।


 
তবে ভিন্ন ব্যক্তির পাসপোর্ট নিয়ে নিরাপত্তার প্রথম ধাপ পেরিয়ে প্রথমে বিমান বন্দরে প্রবেশ, বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ, ইমিগ্রেশন, চেকিং, শেষ ধাপে বোর্ডিং ব্রিজে চূড়ান্ত যাচাই শেষে উড়োজাহাজে আরোহন-যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট নিয়ে নিরাপত্তার সব ধাপ পেরিয়ে অত্যাধুনিক সিস্টেমের ফাঁক গলিয়ে বহির্গামী যাত্রী কি করেই বা বিদেশ গেলেন, সে প্রশ্নই উঠেছে জোরেশোরে।
 
বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বহীনতা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষের অনিয়মসহ সামগ্রিকভাবে হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা আর নিরাপত্তাহীনতার চিত্রটিই উঠে এসেছে ভুয়া পাসপোর্টে মাজেদা নামে এক নারীর দেশে ফেরার মাধ্যমে।
 
সূত্রমতে, মাদারীপুরের রেহানা বেগমের পাসপোর্ট নিয়ে রাজশাহীর মাজেদা বেগম ২০১৫ সালের ১ আগস্ট বিমান বন্দরে আসেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র (নং- SA-I-2015-0274123) নিয়ে সৌদি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে (এসভি-৮০৫) ‘রেহানা’ পরিচয়েই জেদ্দা যান মাজেদা। চলতি মাসের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন।
 
বহির্গমনের সময় তার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের উপপরিদর্শক (এসআই) ফজলার রশিদ।
 
তিনি পাসপোর্টের সঙ্গে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র দেখে ইমিগ্রেশন সিল দিয়েছেন। তবে যাত্রীর সঙ্গে পাসপোর্টের ছবি মিলিয়ে দেখেন নি। যা দায়িত্বে অবহেলার চিত্র।
 
রেহানা বেগমের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। তিনি কালকিনি থানার খাউখান গ্রামের মোন্নাত সিকদারের মেয়ে। স্বামীর নাম দেলোয়ার শেখ।
 
২০১৫ সালের ৫ মে রেহানা বেগমের নামে প্রথম পাসপোর্টটি (নং- বিএফ-০৭৫৯৩৪৩) ইস্যু করা হয়। যার মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখ ২০২০ সালের ২৫ মে।
 
অন্যদিকে মাজেদা রাজশাহীর মোহনপুর থানার হাটরা খামারপাড়া গ্রামের ইয়ানুচের স্ত্রী।
 
এদিকে সেই রেহানা বেগমের নামেই মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর দ্বিতীয় পাসপোর্টটি ইস্যু করা হয়। যার নম্বর-বিএইচ-০৮৬৯৩৬৮, মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখ ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর।
 
নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তির নামে একাধিক এমআরপি পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগই নেই। ২০১০ সালে চালু হওয়া যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে চার আঙুলের ছাপ, ডিজিটাল স্বাক্ষর নেওয়ার পাশাপাশি নেওয়া হয় মুখের ছবি। এমআরপিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৩৮টি নিরাপত্তা বিষয় যুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাসপোর্টের প্রথম পাতায় থাকে জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন নম্বরও।
 
যখন নতুন কোনো পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় আগের পাসপোর্ট নম্বরের তথ্য সংযোজন করে আগেরটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল করা হয়।
 
তবে নিয়ম এখানে উল্টো। এ যাত্রায় নিয়ম ভেঙ্গে একই নামে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ভিন্ন আরেকটি ছাড়পত্র (SA-I-2016-0331742) ইস্যু করে। সেটি নিয়েই ২০১৬ সালের ১৯ জুন কাতার এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে (কিউ আর -৬৩৫) সৌদি আরবের রিয়াদ পাঠানো হয় অন্য নারীকে।
 
এভাবে এক ব্যক্তির পাসপোর্টে অন্যজনকে বিদেশে পাঠানোর নেপথ্যে ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি থেকে জাল ডকুমেন্ট তৈরির কাজে এজেন্ট হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করে রাজধানীর ১৪৭/২ ডিআইটি এক্সটেনশন রোড, ফকিরাপুলের মেসার্স এম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি।
 
যদিও এ ঠিকানায় গিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায় নি।
 
মাজেদা বাংলানিউজকে জানান, তিনি অতকিছু বোঝেন না। ঠিকঠাক মতোই বিদেশ গেছেন। সেখান থেকে কষ্টের টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। এখন দেশে ফিরেই বিপাকে পড়েছেন। পাসপোর্টে, ভিসা, বিএমইটির ছাড়পত্র সবই দালালরা করে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
 
তবে রেহানার পাসপোর্ট ব্যবহার করে দ্বিতীয় দফায় পাঠানো নারী যাত্রীটি আদৌ রেহানা কি’না তা নিয়েও নিশ্চিত নন সংশ্লিষ্টরা।
 
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুকিত হাসান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টির তদন্ত চলছে। অভিবাসন পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় দোষীদের খুঁজে বের করা হবে।
 
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা, মাজেদার মতোই রেহানার পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভিন্ন কোনো নারীকে পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে।
 
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) নিরাপত্তার মান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি।
 
কি করে একই নামে একাধিক পাসপোর্ট সচল হলো, ভুয়া যাত্রী বোর্ডিং কার্ড পেলো, ভুয়া যাত্রীর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হলো, কিংবা একই নামের পাসপোর্টের বিপরীতে দু’বার জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র মিললো এসব প্রশ্নেই এখন তোলপাড় বিমানবন্দরের সর্বত্র।
 
বিভিন্ন সংস্থা এসব উত্তর চেয়ে পরস্পরকে দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেও পায়নি সন্তোষজনক কোনো জবাব।
 
তবে অভিবাসন পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, দু’দফায় ভুয়া নামে ইমিগ্রেশন চ্যানেল অতিক্রমের সময় যে কর্মকর্তারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের সনাক্ত করা হয়েছে। তাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হবে। সন্তোষজনক জবাব না পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
তবে বিমানবন্দরে কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাংলানিউজকে জানান, সংঘবদ্ধ চক্রের সহায়তা ও যোগসূত্র ছাড়া এমনটি হওয়ার নয়। এখানে সবাই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। যে কারণে গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
 
উদ্বেগ আর বিচলিত হয়ে তিনি জানান, এক ব্যক্তির পাসপোর্ট নিয়ে অন্য ব্যক্তির বিদেশ গমন এটা যে কতবড় নিরাপত্তার ঘাটতি তা বলে বোঝানো যাবে না। কারণ অশুভ উদ্দেশে এমনটি হলে মাঝ আকাশে থাকা চলন্ত প্লেনে কেউ নাশকতা করলেও ধরা যাবে না আসল অপরাধীকে।
 
অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশনে গড়মিল পেলে ওই যাত্রীকে আটক করতে পারতো। ভাগ্যিস অন্য দেশেও চোখ এড়িয়ে গেছে।
 
তবে রেহানার পাসপোর্টে যদি মাজেদার ছবি বসানো হয়, সেক্ষেত্রেও পুলিশ ভেরিভিকেশন নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। কারণ দু’জনের বাড়ি দুই জেলায়।
 
সব মিলিয়ে দেশের একমাত্র প্রধান বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্রটি কেমন তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মাদারীপুরের রেহানার পাসপোর্ট দিয়ে সৌদি আরব ঘুরে আসা রাজশাহীর মাজেদা- যোগ করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।