সরেজমিনে দেখা যায়, আইন না মেনে ভিআইপি সড়ক দিয়ে এসব রিকশা ভ্যানের অবাধ চলাচল ঘটছে ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই। পাশাপাশি এসব রিকশা-ভ্যান চালকের আইন ভাঙার সুযোগে লাভবান হচ্ছেন এক শ্রেণীর অসাধু ট্রাফিক পুলিশ সদস্য।
ভিআইপি সড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে উলটো পথে ছুটে আসা এসব ভ্যান ও রিকশার কারণে রাজধানীতে প্রায়ই ঘটছে মারাত্মক সব সড়ক দুর্ঘটনা। আর হুট করেই উল্টোপথে থাকা অবস্থাতেই এ সব পরিবহনের রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার দৃশ্যও অপরিচিত নয় রাজধানীতে। আর পুরো ঘটনা চলমান রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের ‘ঘুষ নয় চা খাওয়ার টাকা’ সংগ্রহের অজুহাতে।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার ফার্মগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কারওয়ান বাজার থেকে উল্টোপথে সবজি ভর্তি ভ্যান ও রিকশা ছুটে আসছে ফার্মগেটের দিকে এবং হুট করেই রাস্তা ক্রস করে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করছে। আর সিগন্যালের উল্টোপথে ঘটনাগুলো ঘটছে ঠিক ফার্মগেট ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনেই। সকাল সাড়ে সাতটায় আগারগাঁও এলাকার সবজি বিক্রেতা সজীব কারওয়ান বাজার থেকে সবজি কিনে রিকশা ভর্তি সবজি নিয়ে যাচ্ছেন উল্টোপথে। রিকশাচালক রাস্তা পার হলেন একেবারে অসতর্কভাবে। হঠাৎ সামনে রিকশা চলে আসায় চলন্ত গাড়িগুলোকে জোরে ব্রেক কষতে হলো। এছাড়া সকালে রাস্তায় যানজট না থাকায় গাড়িগুলো চলে দ্রুত গতিতে। সজীব জানান, সঠিক পাশ দিয়ে আসতে হলে একটু বেশি ঘুরতে হয়। তাই রিকশা ভাড়াও অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া সকাল আটটার পর রিকশা রাস্তায় থাকতে পারবে না। তাই তাড়াতাড়ি যেতে এপাশ দিয়েই চলে এসেছি।
বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও বলেন, মৃত্যু আল্লাহর হাতে। সঠিক পথে আসতে গেলেও মরতে পারি। ওইটা চিন্তার বিষয় না।
এই একই বক্তব্য উল্টোপথে চলমান প্রত্যেকটি সবজি ব্যবসায়ী ও ভ্যান-রিকশা চালকদের।
এ ব্যাপারে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য,‘রিকশাওয়ালারা অশিক্ষিত। কিছু বললে হাত পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু সজীবের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তিনি সরকারি কলেজে অনার্স পড়ছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এ ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি।
এদিকে ট্রাফিক পুলিশের মতে সকাল আটটা পর্যন্ত ভিআইপি সড়কগুলোতে রিকশা কিংবা ভ্যান চলতে পারবে। ফার্মগেটের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সার্জেন্ট রেজা জানান, ‘আমরা আটটা পর্যন্ত রাস্তায় ভ্যান রিকশা চলতে দেই। তবে উল্টোপথে চলাচলটাকে মানবিকভাবে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখি। সকালেও রাস্তায় চাপ কম থাকে তাই এটা ঘটে। ’
কিন্তু কারওয়ান বাজারে যেতেই গোমর ফাঁস হয়ে বেরিয়ে এলো ‘মানবিকভাবে ক্ষমা’র কারণ। সবজি ভর্তি ভ্যান-রিকশা ও মিনি ট্রাক প্রত্যেককেই চাঁদা দিতে হচ্ছে দু ধাপে। প্রথমমত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রতি ঘণ্টার টোল। যা নির্ধারিত ৩০ টাকা। যদিও টাকার রশিদে ভিন্ন ভিন্ন পরিবহনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চাঁদার পরিমাণ উল্লেখ করা আছে। তবে রশিদ নিতে দেখা যায়নি কাউকে। আর দ্বিতীয় ধাপে চাঁদা বা ঘুষ নয় ‘চা খাওয়ার’ জন্য প্রতিটি মিনি ট্রাক, ভ্যান ও রিকশা থেকে নেয়া হচ্ছে ১০ টাকা হারে। হাতে নাতে ধরা খাওয়ার পর এক ট্রাফিক কনস্টেবল বলেন, এটা চা খাওয়ার টাকা দেয়। এখানে কোনো ঘুষ নেই। সারাদিন ডিউটি করি তো তাই চা সিগারেট পান করতেই এই টাকাটা দেয়।
ভোর থেকে হাজার হাজার রিকশা ভ্যান, ট্রাক,পিকআপ ছোটে কাওরান বাজার থেকে। প্রত্যেকটি থেকে ১০ টাকা হারে চাঁদা নিলে টাকার অঙ্ক কত হয় আর সারাদিনে কত কাপ চা খাওয়া লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কনস্টেবল আরও বলেন, এই টাকাটা একসঙ্গে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নেই সারাদিন পর। দিতে হয় সবাইকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর ট্রাফিক পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, আমরা অভিযোগ পেলেই তদন্ত করি। এ রকম ঘটনা ঘটে না সাধারণত। তাও আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তবে মতিঝিল এলাকার তরুণ সবজি ব্যবসায়ী রুমন বলেন, আমি ব্যবসা করছি গত ৪ বছর ধরে। কারওয়ান বাজার থেকেই পাইকারি কিনে নিয়ে যাই। এই চাঁদা ছাড়া কাওরান বাজার থেকে কখনোই বের হওয়া সম্ভব নয়। না দিলে কোনো না কোনো মামলা দিয়ে দিবে ট্রাফিক পুলিশ। তার চেয়ে ১০ টাকা দেয়াই ভালো। আর এটা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানে বলে আমার ধারণা।
এছাড়া ‘চা খাওয়ার’ টাকা নেয়ার সময় বাংলানিউজের ক্যামেরায় ধরা খাওয়া ট্রাফিক কনস্টেবলের বক্তব্য অনুসারে এ ধারা নতুন নয়। আর ভাগও পায় সবাই।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৮ ঘণ্টা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
এমএএম/আরআই