ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পথে পথে মৃত্যুকূপ!

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭
পথে পথে মৃত্যুকূপ! পথে পথে মৃত্যুকূপ! ছবি: সোহেল সরওয়ার 

টেকনাফ ও উখিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে: জাতিগত নিধনের সহিংসতায় জ্বলছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্য। সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের মুখে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরি হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।

গত ২৪ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারে চলছে সহিংসতা।  প্রথমদিকের মতো ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের ঢল না থাকলেও এখনও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর শিশু শরণার্থীরা।

তাদের বেশিরভাগই হারিয়েছেন পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে। কেউ কেউ নিজেরাও হয়েছেন বর্বর নির্যাতনের শিকার। আগুনে পুড়ে হারিয়েছে সহায়-সম্বলও।

মংডুর ন্যাইসাপুরা গ্রামের সোনামত আহমেদ গত মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। সহিংসতায় হারিয়েছেন সন্তান ও দুই ভাইকে। আগুনে ঘর-বাড়ি সহায় সম্বল পুড়িয়ে হয়েছেন সর্বশান্ত।  
টেকনাফ ও উখিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প
শরণার্থী ক্যাম্পে দাড়িয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব এ আশ্রিত রোহিঙ্গা বাংলানিউজকে জানালেন ‘সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ভয়াবহ দু:সহ দিনগুলোর অভিজ্ঞতা’।  

তিনি বলছিলেন, ‘পথ নয় যেন মৃত্যুকূপ’।

সোনামত আহমেদের ভাষ্যে, ‘কোরবানির ঈদের পরে দিনটা ছিলো মঙ্গলবার। মধ্যরাতে নাইস্যাপুরা গ্রাম ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনী। পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। জ্বালিয়ে দেয় ঘর-বাড়ি। চিৎকার-চেচামেচি করে মানুষের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি’।  

‘ঘুমের ঘোরে দেখি, ঘরের টিনে আগুন। তিন ছেলে ও আমি দৌড়ে বের হই। জ্ঞানশূন্য হয়ে কোলের বাচ্চা নিয়ে বউও বের হয়ে পড়েন। পুড়ে মরে তিন বছরের আরেক মেয়ে সন্তান। পালানোর সময় সেনাদের গুলিতে মারা যান দুই ভাই’।
 

তিনি বলেন, ‘মংডুর মাঝেরপাড়ায় দূর সম্পর্কে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেই। সেখানেও আতঙ্কে দিন কাটতো, রাতে ক্ষেতে লুকিয়ে থাকতাম।  চারদিন পর নাইস্যাপুরা গ্রামে গিয়ে দেখি, চারদিকে জ্বলন্ত মরুভূমি। খোলা আকাশের নিচে রয়েছে কয়েকটি পরিবার। গ্রামে দেড় হাজার ঘর ছিলো। আগুনের হাত থেকে বেঁচে গেছে মাত্র সাত-আটটি ঘর। পুড়ে কয়লা হওয়া সাত পুরুষের ভিটা দেখে হাউ-মাউ করে কাঁদি’।

এ পর্যন্ত বলে থেমে যান সোনামত। এ যে অবর্ণনীয় কষ্ট, দু:সহ স্মৃতি ও নরপশুদের হিংস্রতার কথা। তার চোখে-মুখে এখনো বর্বরতা দেখে আসার আতঙ্ক।

‘চারিমিক্যা অইন আর অইন, গ্রাম বিয়াগ্নিন পুড়ি গিয়ে’- আবার শুরু করলেন সোনামত। বললেন, ‘পথে পথে মানুষের দৌড়া-দৌড়ি, চোখের সামনে জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম। ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল পুড়ে মরায় বিষাক্ত দুর্গন্ধ। জ্বলন্ত জিনিসপত্র থেকে উঠছে ধোঁয়া।  

‘ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটার সময় কানে আসে এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ। কোথাও মাদ্রাসায় আগুন, কোথাও  জ্বলছে মসজিদ। অসহায় মানুষের গগন বিদারী চিৎকার!’ 

ভয়াবহ দিনগুলোর কথা তুলে ধরার সময় সোনামতের মুখে-অবয়বে ফুটে উঠছিলো কখনো আতঙ্কের ছাপ, কখনো অসহায়ত্ব আবার কখনো বা উদ্বেগ।
সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় পথে পড়ে মংডু জেলার উত্তরের গ্রাম লুদাই।  

‘আইবর সমত দেখক্ক্যি- উদা মরা আর উদা মরা’- আতঙ্কিত স্বরের বর্ণনা সোনামত।  

তিনি আরও বলেন, ‘আসার সময় লুদাই গ্রামে এসে দেখি, রাস্ত‍ার ধারে ক্ষেতের পাশে মরদেহ আর মরদেহ। কোথাও জবাই কর‍া গলাকাটা মরদেহ পড়ে রয়েছে, কোথাও বা পচে-গলে গেছে।  প্রতি পদে পদে ছিলো ভয়, কখন গুলি লাগে।  
টেকনাফ ও উখিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প
মানুষের প্রতি মানুষের হিংস্রতা বিস্ময়ে হতবাকও করে দেয় সোনামতকে। তার লোমহর্ষক বর্ণনায় জানাচ্ছিলেন, ‘পথে পথে নানা বিপদ নিয়ে ছুটেছি। কোয়ারবিল গ্রামে এসে দেখি, মানুষের দৌড়া-দৌড়ি। সেনারা দড়িবেঁধে রোহিঙ্গাদের চালান দিচ্ছেন। মগরা গুলি করা মরদেহকে আবার জবাই করছেন’।
 
আসতে পথে আরো পার হতে হয় নয়াপাড়া, চিংড়িপাড়া, কেয়ারিংক, চিকুনপাড়া ও বলিবাজার গ্রাম। ওই গ্রামগুলোরও প্রতিটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই আগেই পালিয়ে আসায় জনশূন্য দেখতে পান সোনামত।  

ভিটে-মাটিহারা এই রোহিঙ্গা জানাচ্ছিলেন, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি দেখতে পাননি, সব‍ পুড়ে ছাই। শুধু ফেলা আসা সবুজ ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত, যা লুটে-পুটে খাবেন মগরা।      
 
সোনামতের স্ত্রী মাইমুনা বেগমও জানালেন, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাতটা কাটে বলিবাজারে। এই সীমান্ত গ্রামের পাহাড়ি জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন একদিন। ঝোঁপ-ঝাড়ে লুকিয়ে থাকা মাথার ওপর মুহূর্মূহু গুলির শব্দ।  একটু এদিক-ওদিক হলে সেখানেই প্রাণবায়ু বের হয়ে যেতো।     
 
ওই গ্রামে তাদের সঙ্গে আশ্রয় নেওয়া সিরাজের পায়ে গুলি লাগে। ছেলেটি এখন হাসপাতালে বলেও জানান সোনামত- মাইমুনা দম্পতি।   
 
এভাবে ‘পথে পথে মৃত্যুকূপ’ মাড়িয়ে নাফ নদী পার হয়ে শাহপরী দ্বীপ দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন সোনামত, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পে  এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে রয়েছেন এই ঘরহীন রোহিঙ্গা পরিবারটি।  

জাতিসংঘ ও সরকারের তথ্যমতে, ২৪ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত চলমান ওই সহিংসতায় নতুন করে প্রায় চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। তবে স্থানীয়দের মতে, নতুনদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৫টি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন।  

বাংলাদেশে আশ্রিত প্রত্যেক নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীরই রয়েছে এ ধরনের এক-একটি করুণ গল্প, যেখানে ফুটে ওঠে মিয়ানমারের সেনা আর মগদের নির্মমতার চিত্র।

বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭
এমসি/এএসআর 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।