ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সেনাবাহিনীর পোশাকে হত্যাযজ্ঞে মগরাও!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭
সেনাবাহিনীর পোশাকে হত্যাযজ্ঞে মগরাও! সেনাবাহিনীর পোশাক পরা মগরাও হত্যাযজ্ঞে মেতেছেন, অভিযোগ রোহিঙ্গাদের। ছবি: সোহেল সরওয়ার

টেকনাফ, উখিয়া থেকে ফিরে: জাতিগত নিধনের ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইছে বিশ্বজুড়ে। দেশটির সেনাবাহিনী হত্যা করেছে অসংখ্য রোহিঙ্গাকে। সেনা সদস্যদের দেওয়া পোশাক পরে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে হত্যাযজ্ঞে মেতেছিলেন স্থানীয় মগরা- এমন অভিযোগও তুলছেন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা।

মিয়ানমারের টমবাজার গ্রাম থেকে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে কেবলমাত্র স্ত্রী আর এক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আসতে পেরেছেন মোহাম্মদ নূর। চোখের সামনে হত্যা করা হয় তার বড় ভাই ও বাবাকে।

গত ২৪ আগস্ট শুরু হওয়া সহিংসতায় হারিয়েছেন সর্বস্বও।
 
তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গ্রামের স্থানীয় মগরাও মানুষের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন। বেশিরভাগ মগই এ সময় সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত ছিলেন’।

‘গত ০২ সেপ্টেম্বর টমবাজারে সেনাবাহিনীর বেশকিছু গাড়ি এসে থামে। স্থানীয় একটি বাজারে গাড়ি থেকে নামেন সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত শ’খানেক মগও। তাদের না ছিলো কোনো নামের ব্যাজ, না ছিলো সেনাবাহিনীর কোনো ক্যাপ। গাড়ি থেকে নেমেই কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেন তারা’।

এসব বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই বন্দি অবস্থায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন বলেও জানান মোহাম্মদ নূর।
 
বুচিডং এলাকার বখাটে মগদের হাতেও সেনাবাহিনী অস্ত্র ও পোশাক দিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেছেন একই ক্যাম্পের শরণার্থী মোহাম্মদ রফিক।

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী যখন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আগুন দিচ্ছিলো, তখন আমরা প্রতিরোধে লাঠি-সোটা নিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু দূর থেকে দেখলাম, এলাকার মগদের মধ্যে যারা বখাটে হিসেবে পরিচিত, তাদের প্রত্যেকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা, হাতে অস্ত্র। গুলি করতে করতে এগোচ্ছেন তারা’।

‘আমাদের সামনে যারা ছিলেন, তারা সবাই গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমরা তখন পিছু হটি। পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে আসি। এছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না’।
 
সেনাবাহিনীর পোশাক পরা মগরা বুচিডং এলাকার অন্তত ১০০ রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ শেষে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন বলেও অভিযোগ শরণার্থীদের।
 
রাইখ্যং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা রাইম্মা বিলের ১২ বছরের সখিনা জানায়, সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত দু’জন যুবক ধর্ষণ করেন তাকে। তবে একাধিকবার ওই যুবকদের গ্রামের বাজারে দেখেছে সে। তাদেরকে সাধারণ মগ হিসেবেই জানতো। কিন্তু ধর্ষণের সময় তাদের পরনে ছিলো সেনাবাহিনীর পোশাক।

সখিনাকে ধর্ষণের আগে বাবা আবদ্দুল্লাহকে জবাই করেন তারা। আশেপাশের শরণার্থীরা জানান, সখিনা এখনো কারো সামনে যেতে ভয় পায়। ধর্ষিতা হয়েছে- এ কথা বলতেও আতঙ্কে কথা বের হয় না মুখ দিয়ে। এ নির্মমতার শিকার শুধু সখিনাই নয়, গ্রামটির আরও একাধিক নারীই হয়েছেন। সেদিন সেনাবাহিনীর পোশাক পরেই এ ধরনের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন মগরা।
 
সহিংসতার শিকার হয়ে দেশত্যাগী রোহিঙ্গা শিশুরা।  ছবি: সোহেল সরওয়ারসহিংসতার নির্মমতা কতোটা ভয়াবহ ছিলো, তা ভাষায় প্রকাশ করার উপায় যেন খুঁজে পান না ওই রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও। অনেকেই বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। কিন্তু কেন মগদের সেনাবাহিনীর পোশাক দেওয়া হয়েছিলো, সে প্রশ্ন সবার।

তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরেও যেতে চান রোহিঙ্গারা। তবে এবার সবার আগে চান জীবনের নিরাপত্তা।

গত ২৪ আগস্ট আরাকানের পুলিশ চৌকিতে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার পর থেকেই সহিংসতায় পুড়ছে রাখাইন রাজ্য। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সন্ত্রাসী নিধনের নামে গণহত্যা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নির্যাতনের পাশাপাশি জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন নারীরা। এরই ফলশ্রুতিতে শুরু হয় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের জনস্রোত।

জাতিসংঘ ও সরকারের তথ্যমতে, ২৪ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত চলমান ওই সহিংসতায় নতুন করে প্রায় চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। তবে স্থানীয়দের মতে, নতুনদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৫টি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭
ইউএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।