বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্প রোদের স্বস্তিটা টের পাওয়া গেল, রোহিঙ্গা শিশুদের অবাধে চলাফেরা দেখে। এরপরও ক্ষুধার কষ্টের কাছে এ স্বস্তি যেন সামান্যই।
কাঁটাতার সংলগ্ন নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম ক্যাম্পের এক ত্রিপল ও বাঁশের তৈরি খুপড়ি ঘরে ১১ সন্তান নিয়ে থাকেন সফুরা। তাবুর ভিতর থেকে শোনা যায় ক্রদনরত শিশুকে ধমকানোর শব্দ।
খুপড়ি ঘরটাতে উঁকি দিয়ে ধমকানোর কারণ জানতে চাইলে বলছিলেন, 'ওদের পেটে যেন রাক্ষুসে ক্ষুধা। খাইতে না পারলে খালি ভ্যা ভ্যা কাঁদে। কোলের বাচ্চা কাঁদলে সহ্য হয়। '
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বেঁচে অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। রাখাইন রাজ্যে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশ শিশু ও নারী। এদের বেশির ভাগই হারিয়েছেন পরিবারের কোনও না কোনও সদস্য। নিজেরাও কেউ কেউ বর্বর নির্যাতনের শিকার। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের অন্য সম্বল না থাকলেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে এক পাল করে সন্তান।
তাদেরই একজন মংডুর সবচেয়ে বড় গ্রাম হাইস্যা পাড়ার বাসিন্দা সফুরা। মিয়ানমার সেনার হাতে স্বামী মারা গেলে ১১ সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ঘুমধুম সীমান্ত ক্যাম্পে। প্রতিদিনের খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
সফুরা জানান, তার কোলের সন্তানের বয়স এক বছর। বড়টা ১৪ বছরের। এক দিন তিন কেজি চাল পেলে তিনদিন চলতে হয়। বাচ্চাদের ক্ষুধা মিটবে কিভাবে। একবেলা সিদ্ধ ভাত খেয়ে থাকে তার বাচ্চা। কোনোদিন কোন ত্রাণের গাড়ি থেকে খিচুরি পেলে তা দিয়ে দিন পার।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা দেশান্তরী হওয়া শরণার্থীদের ত্রাণ মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছেন। ত্রাণের কাপড়, চাল ও শুকনা খাবার দিয়ে কাটছে তাদের জীবন। কোনো দিন ত্রাণের গাড়ি না আসলে সন্তান নিয়ে অভুক্ত থাকতে হয় রোহিঙ্গা বাবা-মাকে। ৭ সেপ্টেম্বরে বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে যাকের মৌলভী। আট সন্তান, বৃদ্ধ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সেনাদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে পালিয়ে এসেছেন।
মংডুর নাসাপুরু গ্রামের মাদ্রসায় শিক্ষকতা করত জাকের। কৃষি জমি ও শিক্ষকতার টাকা দিয়ে স্বচ্ছলভাবে চলত সংসার। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়ে অভাব কাকে বলে বুঝেছেন যাকের। বাংলাদেশে পা দিয়ে ২ দিন সন্তানদের মুখে পানি ছাড়া কিছু তুলে দিতে পারেন নি। টুকটাক বাংলা বোঝা শিক্ষিত যাকের বলছিলেন,আজ ১৪ দিন হলো বাংলাদেশে এসেছি। মোট ১৫ কেজি চাল পেয়েছি। ১১ জনের সংসারে দিনে কম হলেও ৩ কেজি চাল লাগে। সকালে ত্রাণের বিস্কুট বিকেলে ভাত আর কোনো খাবার খাই না। এভাবে সংসার চলছে। বাচ্চারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলেও উপায় নেই।
বালুখালি ক্যাম্পের আরেক আশ্রিতা খুদেজা। সকালে বালুখালি রেজিস্টার ক্যাম্পের সামনে থেকে ভাত নিয়ে আসে খুদেজার ছেলে। মাঠিতে বসে আলু ভাজি আর সাদাভাত গোগ্রাসে গিলছিলো তার দুই বছরের সন্তান মিনার।
খুদেজা তিন মাসের অন্ত:সত্ত্বা। ঘরে আরও ৭ সন্তান। স্বামী শ্বশুর মিলে ১১ সদস্যের পরিবার। ক্ষুধার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলছে তার।
খুদেজার স্বামী নোয়াবুর জানালেন, ঘরে আগুন দিলে সহায় সম্বল ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। বাংলাদেশের ত্রাণ তাদের একমাত্র ভরসা। ঘরে পোয়াতি বউ অসুস্থ বাপ ও সন্তানদের একবেলা খাবার ঠিকমতো দিতে পারছি না।
ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হচ্ছে জানিয় নোয়াবুর জানান,ত্রাণ নিতে কয়েক কিলোমিটার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ত্রাণের গাড়ির কাছে আসতে চাল ফুরায়, ভাত ফুরিয়ে যায়। তখন খালি হাতে ফিরতে হয়। আবার অনেকেই দুই তিনবার করে ত্রাণ সংগ্রহ করে।
ক্ষুধার কষ্ট, ভাতের কষ্টে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা শিশুরা যেন নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অবুঝ শিশুরা সারাক্ষণ কেঁদে ঝিমিয়ে পরছে। যারা বোঝে তারা ঘরহীন, বাবা মায়েরা অসহায়, তাদের চোখে মুখে অসহায় চাহনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৬ ঘন্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৭
এমসি/আরআই