বড় মেয়ে আনুর বয়স ১২, ছোট ছেলে ছুবির উদ্দিনের বয়স মাত্র দেড় বছর। আরও আছে এক ছেলে ও মেয়ে।
তহুরার সামনে এক কোপে গলা কাটা হয় সলিম উদ্দিনের। রক্তাক্ত হলো ঘরবাড়ি, উঠান। বিধবা হলেন তহুরা। বিপত্তির এখানেই শেষ নয়। পুড়িয়ে দেওয়া হলো তহুরার বাড়ি। সহায়-সম্বল হারিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে তহুরা চার সন্তানকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন বাংলাদেশের পথে। বাংলাদেশের এসে আশ্রয় নিলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
এবার শুরু নতুন যুদ্ধ। ঘর তোলার সামর্থ্য নেই তহুরার। এরই মধ্যে বলিপাড়া থেকে আগত অন্য এক বিধবা নারীর সাথে পরিচয় হয় তার। এক সাথে পলিথিন দিয়ে ছাউনি বাঁধেন। কিন্তু পেটে ভাত জুটবে কী করে?
না আছে চাল না আছে হাড়ি। জীবনটা নিয়ে পালিয়ে আসা তহুরার এসব আনার কি ফুরসত ছিলো! ত্রাণের চালের টোকেন পায়নি তহুরা। তাই ত্রাণ পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। ছোট ছেলে ছুবির কাঁদছে অনবরত। ঘরের দরজার সামনে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তহুরা তাকিয়ে আছেন ত্রাণের লাইনের দিকে।
রাখাইনে পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তহুরা বাংলানিউজকে বলেন, আমার স্বামীকে কয়েকদিন আগেই গলা কেটে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। যা জমি ছিলো ওসবের দিকে তো ফিরে তাকানোর উপায় নাই। এখানে আমি ফকির। না আছে টাকা, না আছে চাল। ঘরে চুলা জ্বলে না গত কয়েকদিন ধরে। ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। জানি না কি গুনাহ করছি যে এই শাস্তি পাচ্ছি।
বিধবা তহুরার ঘড়ে খাবার নাই জেনে তার বাচ্চাদের ডেকে নিয়েছেন সানোয়ারা। তহুরার বাচ্চারা বসে আছে সানোয়ারার চুলার পাশে। সানোয়ারাও একজন বিধবা। সামর্থ্য নেই তারও। তারপরও তহুরার কষ্ট ভাগাভাগি করতে চেষ্টার কমতি নেই তার।
সানোয়ারা বলেন, এখন আমাদের নিজেদের পাশেই নিজেদের দাঁড়াতে হবে। এতে সব সমস্যা তো দূর হবে না। কিন্তু কষ্ট কিছুটা হলেও তো কমবে। এখন আমাদের আর ভরসা করার মতো কে আছে!
তহুরা, সানোয়ারার মত লাখো নারীই নিজ চোখে দেখেছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা। কেউ হারিয়েছেন জীবনসঙ্গীকে, কেউবা স্বজন। জীবনের নৌকার হাল ধরতে হচ্ছে এসব নারীদেরই। কিন্তু এই জীবন যুদ্ধে তাদের কাছে নেই কোনো ঢাল তলোয়ার। তারপরও ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন তহুরা। সন্তানদের আগলে রেখেই সামনের পথে হাঁটতে চান তহুরা, সানোয়ারারা।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা জানান, রাখাইনের বেশিরভাগ গ্রামের পুরুষদেরই হত্যা করা হয়েছে। স্বামী হারানো স্ত্রীরা সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। এ কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
জাতিসংঘের হিসাব অনুয়ায়ী মিয়ানমারের সহিংসতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। বেশিরভাগ শিশু মা-বাবা অথবা পরিবারের কোনো না কোনো স্বজন হারিয়েছে। কেউবা হারিয়েছে মা-বাবা উভয়কেই।
সাড়ে ৬শ রোহিঙ্গা ভাইকে দাফনের সুযোগও পাননি কবির!
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৭
ইউএম/এমজেএফ