রাখাইন রাজ্যের বড়লোক আমির হোসেন। মংডুর লুম্বাগুণা গ্রামে ৩০ কানি জমি ও বিশাল মুদি দোকানের মালিক।
নিরুপায় সর্বশান্ত আমির শতবর্ষী মাকে কাঁধে করে সীমান্ত পাড়ি দেয়। মিলিটারির গুলির ভয়ে বিনা খাদ্যে নয়াপাড়া গ্রামের পাহাড়ি জঙ্গলে লুকিয়ে পার করে পাঁচদিন। তারপর টানা পনের দিনের যাত্রা শেষে আঞ্জুপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আমির।
কয়েকদিন আগেও যিনি ব্যবসা-পাতির রোজগার দিয়ে আমিরের হালেই ছিলেন। তিনিই এখন পুরোপুরি পথের ভিখারী। নতুন আসায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় মেলেনি। পথের ধারে দিন কাটছে তার। বৃষ্টিতে ভিজে বৃদ্ধা মায়ের কাহিল অবস্থা, জেকে বসেছে জ্বর।
পালংখালি বাজারের মেডিকেল সেন্টারে মাকে নিয়ে যাওয়ার পথে দেখা হয় মিয়ানমারের এ আমির হোসেনের সঙ্গে। ঈদের দুইদিন পরে যাত্রা করে ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কষ্টের ছাপ ছাপ এখনও জ্বলজ্বল করছে তার চেহারায়। সাতদিনের নির্মমতা হতবাক করে দিয়েছে একশ বছরে পা রাখা এ বৃদ্ধাকে।
গত ২৪ আগস্ট পর থেকে জ্বলছে গোটা রাখাইন। প্রতিদিনেই সহিংসতায় আগুনে জ্বলছে কোনো না কোনো রোহিঙ্গা গ্রাম। রক্তহিম হওয়া ভয়ে মিয়ানমারে কাটছিলো দিনগুলো তাদের। সাত পুরুষের ভিটা ছাড়ার আগমুহুর্ত পযর্ন্ত ছিলো শান্তি স্থাপনের আশা।
আমির জানালেন তার উপর হিংস্রতার গল্প। 'ঈদের দুই দিন আগে ছোট ছেলেকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলো স্ত্রী সাহানারা। ঘরে আগুন দিলে পুড়ে মরে স্ত্রী ও কোলের সন্তান। পাশের ঘরে আমির হোসেনের দুই সন্তানের সঙ্গে ঘুমাচ্ছিল মা খুইল্লা বেগম। চিৎকার চেচাঁমেচি শুনে জেগে ওঠে দাদির গায়ে উপর পা তুলে ঘুমানো রুকেয়া (১৩)।
হতবিহ্বল রুকেয়া ঘুম থেকে ঠেলে ওঠায় বড় ভাই আবুকে (১৬)। দাদিকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয় তারা। তখন পুরো গ্রাম আগুনের লেলিহান শিখায় রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। পালানোর স্রোতে আমির হোসেনকে পায় তারা। নুরুল পাড়ায় আত্মীয়ের বাড়িতে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আমির হোসেন।
সেখান দুই দিন থাকার পর বৃদ্ধা মাকে ঝুঁড়িতে বসিয়ে বাংলাদেশ মুখো যাত্রা করেন আমির হোসেন। বাড়ি ছাড়লেও বিপদ তাদের পিছু ছাড়েনি। মংডুর নয়াপাড়া গ্রামের ওপর দিয়ে আসতে আগুন ও গুলির মধ্যে পড়েন। ওই গ্রামে হাজারের উপর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুলি ও ধরা পড়ার ভয়ে সাত দিন পাহাড়ে না খেয়ে লুকিয়ে থাকেন বৃদ্ধ মা, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে।
হাঁটতে পারে না বলে পুরো রাস্তায় মাকে কাঁধে বহন করে আমির ও তার ছেলে। গোলা ভরা ধান ও গমের কৃষক ভাতের কষ্ট বোঝেনি কখনও। আসার সময় ধান, করলা, মরিচ ও পটলের ভরাক্ষেত ফেলে পালিয়ে এসেছেন।
মিয়ানমারের এ আমির এখন পুরোপুরি পথের ভিখারি। ভাতের কষ্টে প্রায় মরনাপন্ন। এখন পথের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর থেকে এখনো পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন রোহিঙ্গারা। শুরুর মতো ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের ঢল না থাকলেও রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আর শিশুরা আসছে ছোট ছোট দলে। এদের বেশির ভাগই হারিয়েছেন পরিবারের কোনও না কোনও সদস্য। নিজেরাও কেউ কেউ বর্বর নির্যাতনের শিকার।
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৭
এমসি/এসআই/ওএইচ/