ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সাড়ে ৬শ রোহিঙ্গা ভাইকে দাফনের সুযোগও পাননি কবির!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৭
সাড়ে ৬শ রোহিঙ্গা ভাইকে দাফনের সুযোগও পাননি কবির! রোহিঙ্গা যুবক কবির আহমেদ, ছবি: ঊর্মি মাহবুব

কুতুপালং থেকে: বিশ্বব্যাপী যখন মিয়ানমারের সহিংসতার বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখন দেশটির কর্তাব্যক্তিরা দেখাচ্ছে সন্ত্রাস দমনের অজুহাত। অন্যদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বারবার তুলে ধরছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের কথা।

গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। সাজানো গোছানো এমনই এক গ্রাম ছিল সোহাবপুর।

গ্রামটিকে মরুভূমিতে পরিণত করতে স্থানীয় তরুণদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনারা। বাংলানিউজকে সেই অত্যাচারের কথা বলেন, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ওই গ্রামের বাসিন্দা কবির আহমেদ। তার ভাষায়, প্রাণ নিয়ে পালাবার সময় গ্রামের শত শত প্রতিবেশী, বন্ধু, ভাই সমকক্ষদের ঠিক মতো দাফনও করে আসতে পারেননি!
 
সহিংসতার শুরুর দিকে গ্রামের রোহিঙ্গারা জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে হয়েছে হিতে বিপরীত। যারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘আলেকিন’ বা বিদ্রোহী নামে, জানান কবির আহমেদ। কবির আহমেদ ও তার সঙ্গে অন্য রোহিঙ্গারা, ছবি: ঊর্মি মাহবুব

সেনাদের নির্যাতনের ভয়ে রোহিঙ্গা তরুণরা প্রথমে পালিয়ে যান। তাদের গ্রামে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতিনিধিরা ঘোষণা দেন, সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। আর কাউকে হত্যা করা হবে না। ভয় নেই। শান্তির আশায় ঘরে ঘরে ফিরে আসেন সাধারণ রোহিঙ্গা তরুণরা। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামে সোহাবপুর গ্রামের রাস্তায়। চালায় অতর্কিত হামলা। সাড়ে ৬শ তরুণকে এক সঙ্গে জমা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হাত বাঁধা হয়। প্রথমে তাদের ছুরি দিয়ে জীবিত অবস্থায় কাটা হয় পায়ের গোড়ালি। তারপর কাটা হয় হাতের কব্জি। তরুণদের চিৎকারে ভারি হয়ে উঠে সোহাবপুর গ্রামের বাতাস। সবশেষে কাটা হয় গলা। গলা ঘাড় থেকে আলাদা করে অন্যান্যদের দেখিয়ে উল্লাস করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।  

এমন সময় গ্রামের দুইজন ছেলে কৌশলে হাতের বাঁধন খুলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ানো শুরু করে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তাদের ঘিরে ফেলে স্থানীয় মগরা। তাদের এক পুকুরে রীতিমতো পানিতে ডুবিয়ে মারে মগরা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একে একে প্রায় সাড়ে ৬শ তরুণকে হত্যা করে সোহাবপুর গ্রামে। এক মাঠে জড়ো করে ফেলা রাখা হয় মরদেহ। পুরো গ্রামে মাইকিং করা হয়, যারা গ্রাম ছেড়ে না যাবে তাদের সবাইকে একইভাবে হত্যা করা হবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রাম ছেড়ে যেতেই অন্য রোহিঙ্গারা এগিয়ে আসেন। দাফনের জন্য ভাবতে না ভাবতেই ফিরে আসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর লোকজন।  
 
কবির আহমেদ বলেন, আমাদের রোহিঙ্গা ভাইদের দাফনও নসিব হয়নি। তাদের কোনো রকম গর্ত করে মাটিচাপা দিতে হয়। আমার নিজের হাতে প্রায় সাড়ে ৬শ মরদেহ মাটি চাপা দিয়েছি। এরপর পালিয়ে আসতে হয়েছে; কিছুই করার ছিল না। আমি তো কোনো দিন আলেকিন দেখিনি। জানিও না আলেকিন বা আরসা কি তাহলে আমাদের কেন গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হলো! 
 
সেই দিনের পর সোহাবপুর গ্রাম ফাঁকা হয়ে যায়। সেখানে এখন আর ভোর হলে রোহিঙ্গাদের কাজে যাওয়ার শব্দ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না শিশুদের হাসির শব্দ। কবিরের শঙ্কা সেখানে হয়ত দখল নিয়েছে মগরা।
 পালিয়ে আসা অহসায় রোহিঙ্গা, ছবি: বাংলানিউজ
সোহাবপুরের মতোই রাখাইন রাজ্যের প্রায় ১৬০টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যা করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে। এর সঠিক তথ্য কারোই এখনও জানা নেই।
 
এই নির্মম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী গণহত্যার জেরে এ পর্যন্ত প্রায় সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশের সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৭
ইউএম/আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad