ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ মে ২০২৪, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নবজাতক ও বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা মা!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৭
নবজাতক ও বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা মা! নবজাতক ও বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা মা, ছবি: সোহেল সরওয়ার

বালুখালি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে: বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রিপল টানানো তাবুতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দশদিনের নবজাতক। মাদুরে ঘুমানো শিশুটির ঘন শ্বাসে ওঠা-নামা করছে বুক। নাক থেকে হালকা বাঁশির মতো শব্দ হচ্ছে।

মুরগির খোপের মতো ঘরটির ভেতরে বসে থাকা শিশু সন্তানের মা ইসমত আরা জানালেন, জ্বর-কাশির ঘোরে সারারাত এক ফোটা ঘুমায়নি। তাই এখন একটু ঘুমাচ্ছে।

তবে কাশির তোড়ে যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে শিশুটির ঘুম।

মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসা দেড় বছরের আরো একটি সন্তানকে নিয়ে কেবলই দুঃখের দিন কাটছে ইসমতের। কোলের সন্তান কেদে উঠলে অন্যজনও কান্না জুড়ে দেয়। সন্তানদের কান্না আর ক্ষুধায় দিশেহারা এই রোহিঙ্গা নারী। প্রসূতি শরীরে নিজের খাবার দরকার হলেও না খেয়ে খাওয়াচ্ছেন শিশু সন্তানদের।

পৃথিবীর আলো দেখার চারদিন পর ধরা পড়েছে নিউমোনিয়া। বালিখা অস্থায়ী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের গুমোট পরিবেশে এ রোগে ধুঁকছে দশদিনের নবজাতক আবদুল্লাহ আবু। নবজাতক ও বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা মা, ছবি: সোহেল সরওয়াররাখাইনের মংডুর ফকিরা বাজার থেকে এক সপ্তাহ হেঁটে বাংলাদেশে আসেন দশ মাসের অন্ত:সত্ত্বা ইসমত আরা। ১১ সেপ্টেম্বর পালংখালি আঞ্জুপাড়া সীমান্ত পয়েন্টের নো-ম্যানস ল্যান্ড পার হওয়ার পর ফাড়িরবিল প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জন্ম দেন তৃতীয় সন্তানটিকে। থ্যাইংখালীর রাস্তার ধারে সদ্যজাত ছেলেকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কাটে প্রথম চারদিন। শরণার্থী ক্যাম্পে ওঠার দিনই খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসে।

পরে মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানান, নিউমোনিয়া। কক্সবাজারে নিয়ে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছেন। উপায় না পেয়ে স্বামীহারা ইসমত আরা শিশুটিকে মেডিকেল ক্যাম্প থেকে নিয়ে এসে এভাবেই পড়ে রয়েছেন দুই সন্তানসহ।

মিয়ানমারের সেনা ও মগরা তার স্বামী ও এক দেবরকে মেরে ফেলেন। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধ শ্বশুর ও দেবরদের সঙ্গে পাহাড় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এক দেবরের কোলে ছিলো দুই শিশু।   আরেক দেবরের হাত ধরে এতোটা পথ হেঁটে আসেন এই রোহিঙ্গা নারী।

থাকার জায়গাটি পুরোপুরি ঠিক হলে কক্সবাজার সদরে গিয়ে সন্তানের চিকিৎসা করাবেন। ইসমত আরার ঘরে রয়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শ্বশুর। তারও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। মাথা গোঁজার ঠাঁই রক্ষা করতে অন্য কোথাও যেতেও পারছেন না তারা।  

সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার বীভৎস অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইসমত আরা বলছিলেন, ‘পথে আসতে বহুবার ব্যথা ওঠে। মনে হয়, এক্ষুণি কিছু একটা হবে। এরপরও কোথাও কোথাও মিলিটারির ভয়ে দৌড়ে আসতে হয়। কি কষ্ট ছিলো বোঝাতে পারবো না। ভাবছিলাম, আর বাঁচবো না’। নবজাতক ও বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা মা, ছবি: সোহেল সরওয়ার‘এক মেয়ের পর শখ ছিলো এই ছেলে সন্তানের। বাপেরও খুব ইচ্ছা ছিলো ছেলের। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় জন্মের আগেই বাবাহারা নবজাতক’।

শিশুটির নাম জানতে চাইলে অসহায় এই নারী বলছিলেন, ‘বাপে নাম ঠিক করে দিয়েছেন। মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন তিনি। রাখাইনে গণ্ডগোল শুরু হলে তখনেই আব্দুল্লাহ নামটি ঠিক করে দেন, যার অর্থ আল্লাহর বান্দা। কিন্তু নিজেই সে নামে ডাকতে পারলেন না’।

সামনে ঘোর অন্ধকার ভবিষ্যৎ জেনেও প্রাণ বাঁচাতে  পাড়ি দিয়েছেন বাংলাদেশে। দুই শিশুসহ নিজের চালানোর ভার সৃষ্টিকর্তার হাতে সঁপে দিয়েছেন বলেও জানান মা ইসমত আরা।

কুতুপালং ক্যাম্পে একমাসের নবজাতক তৈমুরও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে এ রোগে ভুগছে সে।

ক্যাম্পটির আরো অনেক শিশুই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। অনেককে গায়ে জ্বর নিয়েই খোলা স্থানে খেলতে দেখা গেছে। হাজারো কষ্ট-নির্মমতা সহ্য করতে করতে এসব শিশু যেন সর্বংসহাই হয়ে উঠেছে।

জাতিসংঘ ও সরকারের তথ্যমতে, মিয়ানমারের চলমান সহিংসতায় গত প্রায় একমাসে নতুন করে প্রায় চার লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। সে হিসাবে প্রায় আড়াই লাখ শিশু শরণার্থী নতুন যোগ হয়েছে।  

তবে স্থানীয়দের মতে, নতুনদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে।  সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৫টি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন।

ক্যাম্পে আশ্রিতরা ছাড়াও টেকনাফ-উখিয়ার রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গারাও নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৭
এমসি/এএসআর

পাহাড়ের ঢালে শরণার্থীদের ক্ষুধার কান্না!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ