সেইসঙ্গে কিছু মুখোশ পরা লোক ছুরি ও তলোয়ার নিয়ে হামলা চালায় গ্রামবাসীর উপর। ফকিরা বাজার এলাকার জুয়েলারির দোকানে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজনকে।
ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন রুবেল পাল। বাড়ি চিকুনপাড়া, কাজের সুবাদে থাকেন ফকিরা বাজারে। রুবেল ওখানকার এক সেলুনে নাপিতের কাজ করতেন। পরে পরিবারের আট সদস্যের সঙ্গে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
রোহিঙ্গা নিধনের এই অভিযানে দেবরকে হারিয়েছেন রাখাইনের চিকুনপাড়ার বাসিন্দা মালতিবালা। ফকিরা বাজার জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর পেয়ে সকাল ১০টার মধ্যে গ্রাম ছাড়ে চিকুনপাড়ার বাসিন্দারা। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার আগে বার্মার লুম্বাশিয়া পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
পাহাড়ের উপর বসে জ্বলতে দেখেন নিজ গ্রাম। এরপর রোহিঙ্গা মুসলামানদের স্রোতে মিশে আশ্রয় নেন বাংলাদেশে।
মালতিবালা বাংলানিউজকে জানান, মিয়ানমার আর্মি ও কালো মুখোশধারীরা শুধু তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়নি, লুটপাট করেছে সবকিছু। দুইটি মন্দিরও জ্বালিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একটা দুর্গা মন্দির, অন্যটা কালী মন্দির। ফকিরা বাজারে বেড়াতে গিয়ে ফেরেনি তার দেবর।
নির্যাতিত হিন্দু রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ৯ নম্বর ওর্য়াডে, পশ্চিম হিন্দু পাড়া গ্রামে।
পশ্চিম হিন্দু পাড়ার বাসিন্দা আশিষ শর্মা তার মুরগীর ফার্মে হিন্দু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। যেদিন প্রথম রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসে সেদিনই ৫১ টাকা দরে মুরগির বাচ্চা এনেছিলেন আশিষ। রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার খবরে ৫০ টাকা দরে সবগুলো মুরগী বিক্রি করে দেন।
সম্পূর্ণ মানবিক কারণে সামান্য ক্ষতি মেনে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন বলে জানান আশিষ।
এখানে ৫১৮ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। তিন দিন আগে নির্যাতিত আরো ৫ রোহিঙ্গা পরিবার এই ক্যাম্পে এসেছে। যাদের কেউ স্বামী হারিয়েছে, কেউ আত্মীয়-স্বজন।
মুসলমান অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে হিন্দু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিতান্তই অল্প। এদের ওপরও নেমে এসেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার।
নাফ নদী পেরিয়ে আসা হিন্দু রেহিঙ্গাদের দেখে মনে হলো-শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু রোহিঙ্গাদের উপরও চলছে নির্যাতন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, রাখাইনে হিন্দু পরিবারের প্রায় ১১০ জন পুরুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে সব বাড়িঘর।
উপায়ন্তর না দেখে এক কাপড়ে সন্তান-পরিজন নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত দিয়ে মুসলমান রোহিঙ্গাদের সঙ্গেই হাঁটা শুরু করে হিন্দু পরিবারগুলো। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ স্বামী হারা, ঘর হারা, অন্তঃসত্ত্বা নারীও রয়েছেন।
আশ্রয় কেন্দ্রে কথা হয় বধুবিবির সঙ্গে। তিনি জানান, তার সঙ্গে আশ্রয় নেওয়া ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অনিকা ধরের স্বামীকে আর্মিরা মেরে ফেলেছে। ফকিরা বাজারে জবাই করে হত্যা করা হয় অনিকার স্বামীকে।
চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদরে যাওয়ার কারণে দেখা হয়নি অনিকার সঙ্গে।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! বিদ্রোহী কবির 'কান্ডারী' কবিতার এই লাইনগুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সেনাদের নৃশংস অত্যাচারের মিলে যাওয়া চিত্র। সেইসঙ্গে নিশ্চুপ ঘুমে থাকা বিশ্ব বিবেকের জেগে ওঠারও ডাক।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৭
এমসি/আরআর