ঢাকা, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ মে ২০২৪, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নৌকাডুবি নয়, নৌকা ডোবানো হয়!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
নৌকাডুবি নয়, নৌকা ডোবানো হয়! দীপু মালাকার-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে ফিরে: আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন সেদেশের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণাথী। রাতের বেলায় নৌকায় করে নাফ নদীর মোহনা এবং সাগর পাড়ি দিয়ে এদের অর্ধেকই এসেছেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ হয়ে।

মূলত দেশের মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণের এই দ্বীপ জনপদের জেটিঘাট, মাঝের ঘাট, গোলার চর ও পশ্চিমপাড়া দিয়েই মাছ ধরার নৌকা করে এই বিপুল শরণার্থী প্রবেশ করে বাংলাদেশে।

আর্ন্তজাতিক সংস্থা ইন্টার সেকশন কো-অর্ডিনেটর গ্রুপ (আইএসসিজি) এর হিসেব অনুযায়ী, ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে চার লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী।

এর অর্ধেকই এসেছে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে সাগর ও নদীপথে। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও রাথেডং প্রশাসনিক এলাকার ১৫০টির ওপর গ্রাম থেকে আসা বেশির ভাগ শরণার্থীই এসেছে এই রুট ব্যবহার করে।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, এখনো প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের মতো শরণার্থী বাংলাদেশে আসার জন্য সাগর ও নদী পাড়ি দিচ্ছে।

আইএসজি বলছে, গত চার দিনে শরণার্থী আসা কমে এসেছে। তবে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের দাবি, বুধবার(২০ সেপ্টেম্বর)পর্যন্ত রাখাইনের নাইক্ষন দ্বীপে এখনো এক লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী আটকে রয়েছে। নৌকা ভাড়া যোগাড় করতে না পারায় এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে থাকা খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেছে এবং প্রকৃতির বিরূপ আচরণে তারা কষ্ট পাচ্ছে।
দীপু মালাকার-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমএরইমধ্যে নাফ নদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, গত ২৫ দিনে শাহপরীর দ্বীপে আসতে গিয়ে বেশ কয়েকটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। আর এতে নিহত হয়েছেন কয়েক ডজন অসহায় মানুষ। এদের বেশির ভাগই শিশু।

টেকনাফের লেদা শরণার্থী ক্যাম্পের বাইরে কথা হয়েছিল মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহর সঙ্গে। তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর পোয়াখালি (বালুখালি)গ্রামে। পরিবার পরিজন নিয়ে  বাংলাদেশে এসেছেন গেলো ২ সেপ্টেম্বর, ঈদুল আজহার দিন। শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে আসার সময় নৌকা ডুবে মারা গেছে তার বড় বোনের পরিবারের সাত সদস্য। তারা হলেন বোন ফয়জুন, দুলা ভাই সৈয়দ উল্লাহ, নাতি ফাতিমা, মিনারা, আয়শা, আয়ুব, ইসমাইল।

মিয়ানমানের পাড় থেকে নৌকায় আসার সময়, সেদেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) বোট নিয়ে ধাওয়া করে। এসময় বোট উল্টে ওই পারিবারের সবাই মারা যায়।

নৌকায় তোলার সময়ই এদেশের মাঝিরা বাংলাদেশে আসতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৬ হাজার টাকা করে আদায় করে। এরপর মাঝ সাগরে এসে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে রামদা বের করে মাঝিরা। এরপর নৌকায় থাকা প্রতিটি পরিবারের নারীদের হাত, কান গলা থেকে গহনা কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর অসহায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আনা বস্তা সরঞ্জাম হাতিয়ে মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী। তারা পাড়ে ফিরে বিষয়টি বিজিবি এবং স্থানীয়দের জানাবেন বলেন। এতে ক্ষেপে যায় নৌকার মাঝিরা। এবং এক সময় তারা ভীত হয়ে সবাইকে বিষয়টি চেপে যাওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে প্রশাসন এবং স্থানীয়দের জানানোর হুমকির কারণে শাহপরীর দ্বীপের গোলারচরের কাছে এসেই নৌকাটি ডুবিয়ে দিয়ে মাঝিরা সাঁতরিয়ে তীরে ওঠে। এই নৌকাডুবির ঘটনায় ১২টি মৃতদেহ উদ্ধার সম্ভব হলেও অনেক শরণার্থীরই আর কোনো খোঁজ মেলেনি। যাদের বেশির ভাই শিশু।

এধরনের ভয়াবহ অমানবিক ও নৃশংস ঘটনার গল্প এখন বলতে শুরু করেছেন এপারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। যার প্রতিটি অংশই মানুষের সীমাহীন লোভের রক্তহিম করা উপাখ্যান। যে কোনো মানুষই এইসব গল্প শুনে শিউরে উঠবেন। এসব ঘটনার শিকার হওয়া অনেকেই প্রচণ্ড মানষিক ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করছেন বলে জানিয়েছে একাধিক আর্ন্তজাতিক সাহায্যসংস্থা।

স্থানীয়রা বলছেন, এরই মধ্যে নৌকায় মানুষ পার করে কোটিপতি বনেছেন শাহপরী দ্বীপের অনেকেই। তবে তারা সবাই এক সময় সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করতো। এরা সবাই স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী এবং পুলিশের খাতায় পলাতক। অথচ প্রশাসনের সামনেই তারা মিয়ানমার থেকে প্রতিরাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।

শাহানা খাতুন নামে একজন শরণার্থী নৌকা পার হয়েছেন চার সন্তান ও স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে।

তিনি জানান, ছয়জনকে পার করতে নৌকার মাঝিরা প্রথমেই সবার কাছ থেকে মাথাপ্রতি ছয় হাজার করে টাকা আদায় করে। এরপর পাড়ের কাছে এসে সবার কাছ থেকে সঙ্গ থাকা সোনার গহনা কেড়ে নেওয়া হয়। তবে ভাগ্য ভালো যে, নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা নিরাপদেই পাড়ে এসে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

কক্সবাজার প্রশাসনের একজন উধর্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন বাঁচাতে সীমান্ত উন্মুক্ত করে বিশাল মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অথচ সেখানে কিছু অসাধু ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত লোভের কারণে দেশের বদনাম হচ্ছে। এদের চিহ্ণিত করে বিচারের জন্য এরই মধ্যে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২২০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
আরএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।