স্বজনের মরদেহ ফেলে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। পাহাড়ের ঢালে নিচু জমিতে গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গল কেটে তাবু টাঙিয়ে বা পলিথিনের ঘর গড়ে পেতেছেন সংসার।
একটু এদিক-ওদিক হলেই ভেঙে পড়তে পারে সেসব ঘর। অবিরাম বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে, কাদা থেকে পিছলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনাও।
পাহাড়ের ঢালের এ শরণার্থী জীবনে রোহিঙ্গাদের কষ্টের শেষ নেই। এর মধ্যে সন্তানের ক্ষুধার জ্বালার কষ্টটাই সবচেয়ে বেশি। খাবারের জন্য শিশুদের কান্নাকাটি থামাতে এখানে নিরুপায় মায়েরা।
ভাতের কষ্ট আর ক্ষুধার জ্বালা ভুলিয়ে দিয়েছে স্বজন হারানোর শোকও। খড়-কূটোর এ সংসার নিয়ে বেঁচে থাকাটাই তাই এখন রোহিঙ্গাদের মূল যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পে ৮ সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন লায়লা বেগম। বড়জনের বয়স ১৪ বছর, সবচেয়ে ছোট কোলের ছেলেটি এক বছরের। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে এই রোহিঙ্গা নারীকে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর বলিবাজারের জিম্মাদার ছিলেন লায়লা। স্বামীও কৃষিকাজ করতেন, কষ্ট ছিলো না সংসারে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গ্রামে আক্রমণ করে ঘর পুড়িয়ে দেয়, স্বামীকে নিয়ে যায়। পরে তার মরদেহ মেলে বাড়ির পাশের ডোবায়।
ত্রাণের সামান্য চাল আর বিস্কুট দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ হয় না শিশুদের। সন্তানদের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে গিয়ে লায়লা বেগম ভুলে গেছেন স্বামী হারানোর বেদনাও।
বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। ক্যাম্পের পাহাড়ের ঢালে একমাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হুজেফা। তাবুর ভেতর থেকে ভেসে আসছে শিশুদের অনবরত কান্নার আওয়াজ।
হুজেফা জানান, ভেতরে আরো চারটি সন্তান রয়েছে তার। সকালে খালি বিস্কুট আর পানি খেয়েছে তারা। বেলা ১২টা বাজায় ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে না পেরে কেঁদেই যাচ্ছে অবুঝ দেড় বছর ও তিন বছরের দুই শিশু।
মংডুর প্রত্যন্ত গ্রাম রশিদং থেকে পালিয়ে আসা হুজেফা বলেন, ‘পালিয়ে আসার সময় পেছন থেকে গুলি করে তার স্বামীকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা। এরপর ১৬ দিন পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায় চড়ে বাংলাদেশে এসেছেন। পথে ছিলো ক্ষুধার কষ্ট, স্বজন হারানোর বেদনা। ক্ষুধার সে কাতরতা এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
হুজেফা বলেন, ‘ত্রাণের বিস্কুট পেলেও কোনো টাকা পাচ্ছি না। দিনে এক কেজির মতো চাল আসে ঘরে। ওখানে ছিলো মগের অত্যাচার, এখানে ক্ষুধার জ্বালা। দিশেহারা আমার মতো সব রোহিঙ্গা শরণার্থীই’।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম সীমান্ত ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আব্দুল্লাহিল তালিব ও তার স্ত্রী আমিনা, সঙ্গে দুই নাতি। চোখের সামনে খুন হওয়া ছেলেদের মরদেহ পেছনে ফেলে সেনাদের অত্যাচারে সাত পুরুষের ভিটা ছেড়েছেন এই বৃদ্ধ।
মংডুর কোয়ারয়িং গ্রাম থেকে টেনে নিয়ে আসা গৃহস্থালি সামগ্রীর বিনিময়ে পাওয়া অর্থে ঘর বেধেছেন বাংলাদেশে। ভাত খাবার তৈজসপত্রটুকুও নেই বৃদ্ধ এই দম্পতির কাছে। গত দশদিন ধরে পলিথিনেই খাওয়া-দাওয়া সারছেন। ত্রাণের সামগ্রী একমাত্র ভরসা হওয়ায় দু’জনে দিনে একবেলা করে খেয়ে নাতিদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।
‘এখন জীবনে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। একটি নাতির জ্বর ভালো হচ্ছে না। দিন-রাত শুধু কান্নাকাটি করে। অবুঝ শিশুদের মুখে ঠিকমতো খাবারও দিতে পারি না’- বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন তালিব।
গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান সলভেশন আর্মি (আরসা) থানা ও পুলিশ ঘাঁটিতে হামলা চালায়৷ এরপর থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী৷ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম৷ সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকারও হন নারীরা। সহিংসতার মুখে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় একমাস ধরেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জনস্রোত। জাতিসংঘ ৪ লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর ১৫টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার কথা জানালেও স্থানীয়দের মতে, এ সংখ্যা প্রায় আট লাখ।
**বাপ-মা হারানো অসুস্থ জাবুল ঘোর অন্ধকারে!
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
এমসি/এএসআর