ধানক্ষেতের হাঁটু সমান কাদামাটি মাড়িয়ে ক্যাম্পে পৌঁছুতে বৃষ্টি যেন তেড়ে এলো। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে পানির স্রোত।
ধান ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল মিয়ানমার অার্মির অত্যাচারে পালিয়ে আসা মিনার হোসেনের সঙ্গে। তিনি শোনাচ্ছিলেন কারো স্বামী, কারো ভাই-বোন, কোনো বৃদ্ধের জোয়ান ছেলে ও মা-বোনের উপর নৃশংস নির্যাতনের রোমহর্ষক সব কাহিনী।
কথা প্রসঙ্গে দেখিয়ে দেয় ধান ক্ষেতের পাশে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদায় দাঁড়িয়ে থাকা তিন বছরের শিশু জাবুল হাসানকে। প্রথম দেখাতে চোখ আটকে যায় শিশুটির উপর। অন্য স্বাভাবিক শিশুদের থেকে শারীরিক গঠন তার ভিন্ন। ডান-পা অস্বাভাবিক শুকনো।
ডাক দিলে সম্পূর্ণ নির্বাক চাহনিতে ফিরে তাকায়। শুকনো পা নিয়ে লেংচাতে লেংচাতে কাছে আসে। মুখে হাত, কুচকানো ভ্রু’র নিচে চোখ তার অসহায়ত্বের জিজ্ঞাসা।
জানা গেল, মংডু জেলার তুলাতুলি গ্রাম থেকে চাচা হয় এমন একজনের সঙ্গে বাংলাদেশে আসে জাবুল। নাফ নদী পেরিয়ে শাহ পরীর দ্বীপে আসে জাবুল ও তার চাচা। এরপর অটোতে একই গ্রামের দিলারা বেগমের কাছে দিয়ে বলে আসতেছি, এরপর আর তার দেখা পাওয়া যায় নি। পরে নি:স্ব শিশুটিকে ফেলে আসতে পারেনি দিলারা। তার অন্য শিশুদের সঙ্গে অাশ্রয় নিয়েছে বালুখালি সীমান্ত ক্যাম্পে।
দিলারা বলেন, জাবুল হাসানের রোগটা সম্পর্কে কিছু বলতে পারি না। দেড় বছর বয়সে এই রোগ শুরু হয়। পায়ে শক্তি পায় না, দূর্বল। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। গরীব বাবা-মায়ের সন্তান হওয়ায় কোনো চিকিৎসা করায়নি কখনও।
দিলারা তার তিন সন্তান নিয়ে ২০ দিন হলো বাংলাদেশে এসেছেন। রাখাইনের তুলাতুলি গ্রামে অার্মি নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। জাবুলের চাচার সঙ্গে একই নৌকায় নাফ পেরিয়ে আসেন। জানতে পারেন, ঘরে দেওয়া আগুনে জাবুলের বাবা-মা পুড়ে মারা গেছে।
দিলারার খড়কুটোর সংসারে অসুস্থ জাবুল যেন অভাবের জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছে। শূন্য হাতে দেশান্তরি হওয়া এ নারী ত্রাণের টাকা ও ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছেন।
'ওরে ভিক্ষা করতে পাঠাতে পারি না। আমি ওরে নিয়ে কি করবো? কেউ যদি জাবুলকে নিয়ে চিকিৎসা করাত। ’ –কণ্ঠে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে বলেন দিলারা।
ক্যাম্পের অন্য বাসিন্দাদের দাবি, জাবুল সংক্রামক পোলিও রোগে আক্রান্ত। বাচ্চাটার ঠিক মত চিকিৎসা না করালে শরণার্থী জীবনের কষ্ট সে সহ্য করতে পারবে না। আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য মতে, রাখাইনে সাম্প্রতিক সহিংসতার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু। জাতিসংঘের হিসেবেই আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
এমসি/জেডএম
আশ্রয়হীন জীবনে সন্তান ভূমিষ্ঠের অপেক্ষা!