কচুপাতার পানির মতো এই সংসারে প্রতিনিয়ত আসছে নানা বাধা-বিপত্তি। উদ্বাস্তু সংসার জীবনে ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির বৈরী আচরণ।
মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজারে সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে দিনভর ছিল ঝড়-বৃষ্টি। পথের ধারে, নিচু এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কষ্টের শেষ ছিল না। বৃষ্টিতে ভিজে নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মানবেতর জীবন যাপন করতে দেখা যায় তাদের।
নির্মমতার শিকার লাখ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া উপজেলার বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বালুখালি বাজার সংলগ্ন রাস্তার ধারে নিচু স্থানের শরণার্থী ক্যাম্পে কোমর সমান পানি উঠেছে। শরণার্থী ক্যাম্পের সামনে খাল থাকায় সাঁকো পার হতে হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে খালের পানিও বুক পযর্ন্ত ওঠে। শরণার্থীদের ব্যাগ-বোচকা নিয়ে আশ্রয় স্থল ছেড়ে অন্যত্র যেতে দেখা যায়। সাঁকো অকেজো হওয়ায় বুক সমান পানি মাড়িয়ে ঘরহীন রোহিঙ্গা যেন স্রোতের শ্যাওল্যার হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে, খুঁজছে নতুন কোনো আশ্রয়। খালের সামনে কথা হয় রাখাইনের মংডু জেলা নিমতলী গ্রামের বাসিন্দা জুয়েলী বেগমের সঙ্গে। স্বামী ও এক সন্তান হারিয়ে এই নারী বালুখালিতে তাবু টাঙিয়ে মাটিতেই সংসার পেতে ছিলেন। ১৪ দিনের এই সংসারে হাঁড়ি-পাতিল কিনে বেশ গুছিয়েও নিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতি তার এই সুখটুকুতেও বাঁধ সাধলো।
তাই মাথায় নিজের সম্বলের সবটুকু চাপিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন এই নারী।
জুয়েলী বলছিলেন, ‘স্বামী পুত মারা যাওয়ার পর থেকে জীবনে আর কিছু নাই। দুইটা বাচ্চা আছে তাদের জন্য বেঁচে থাকা। পানি উঠায় এখানে সব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় থাকা যাচ্ছে না। কয়েকটা দিন রাস্তায় থাকবো পানি শুকালে আবার আসবো। ’
হাতে দুই বছরের ছেলে কোলে সাত মাসের কন্যাশিশু। তার সঙ্গে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে মানুষের সাহায্যে পানি পার হলো মংডুর রাশিদং গ্রামের রুহানী আক্তার। রুহানীর গল্পটাও করুণ। ১৪ দিন পায়ে হেঁটে হোয়াইক্যং লাম্বারবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিনি। পরে অন্য রোহিঙ্গাদের স্রোতের সঙ্গে মিশে বালুখালি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
স্বামীকে আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে এ খবরটুকু জানে না এ রোহিঙ্গা নারী। তিনি ৩ বছরের সংসারে দুই সন্তানের জননী। শরীরজুড়ে দীর্ঘ দিন ধরে অভুক্ত থাকার ছাপ। পালিয়ে আসার পথে ঝোপ-জঙ্গলে দিন কেটেছে তার। কোলের শিশুটির অবস্থাও হাড়জিরজিরে।
রুহানীদের এই ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেলো, স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় পানির ওপরে মানুষের মল ভাসছে। এর মধ্যে ত্রাণের টাকা পেয়ে যে জিনিসপত্র করেছেন সেগুলো গুছিয়ে বেরিয়ে পরছেন।
রইখ্যং শরণার্থী ক্যাম্পে ছেলেসহ পরিবার হারিয়ে নাতনীকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রহিম (৫৬)। শরণার্থী ক্যাম্পে জায়গা হয়নি এই বৃদ্ধের। মংডুর কোয়ারয়িং গ্রামের আরেক বাসিন্দার তাবুতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। আশ্রিতার তাবুর কাদা পানিতেই বৃদ্ধের বসবাস।
নির্মমতা সয়ে অনুভূতিহীন এ বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘কোথাও জায়গা পাইনি। এরা থাকতে দিতে চায় না। যাবো কই! বেশি হাঁটাচলাও করতে পারি না। ’
** জোবায়েরের বুকে বুলেটের ক্ষত
** শরণার্থীদের সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা
** মিয়ানমার আর্মির নির্মমতা এড়াতে উত্তাল নাফ নদী পাড়ি
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
এমসি/এসও/আরআইএস