ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পা নেই, তাই দাঁড়িয়েছেন আত্মমর্যাদার পায়ে আনোয়ার!

শরিফুল ইসলাম জুয়েল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
পা নেই, তাই দাঁড়িয়েছেন আত্মমর্যাদার পায়ে আনোয়ার! পা নেই, তাই দাঁড়িয়েছেন আত্মমর্যাদার পায়ে আনোয়ার!- ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: একটিও পা নেই তার। তাই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। কাউকে দু’বাহু বাড়িয়ে যে জড়িয়ে ধরবেন সে সাধ্যটুকুও তার নেই। কেননা একটিমাত্র হাত তার। তবু ভেঙে পড়েননি, হার মানেননি গাজিপুরের শ্রীপুর উপজেলার আনোয়ারুল শেখ।

দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে না পারলেও দাঁড়িয়েছেন আত্মমর্যাদার পায়ে ভর দিয়ে। কারোর কাছে হাত পাতা কোনো সম্মানের কাজ নয়, বরং এতে মানুষের কাছে অপমানিত হতে হয় বলে মনে করেন আনোয়ারুল।

’৯০ এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের তিন বছর আগে এক দুর্ঘটনায় নিজের এক হাত আর দু’পা হারান। কিন্তু হারায়নি তার বাঁচার ইচ্ছা। স্বপ্ন দেখেছেন নতুন করে বাঁচার, নতুন কিছু করার।

মঙ্গলবার(১২ সেপ্টেম্বর)আনোয়ারুলের সাথে এই প্রতিবেদকের দেখা হয় রাজধানীর কাওলা রেলগেট এলাকায়। এক হাতে আখ কাটতে দেখে সামনে গিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমে রাজি হননি আনোয়ারুল।
পা নেই, তাই দাঁড়িয়েছেন আত্মমর্যাদার পায়ে আনোয়ার!- ছবি: বাংলানিউজতিনি বলেন, পৃথিবীতে মানুষ মানুষের ভালো চায় না। সবাই সুযোগ পেলেই ক্ষতি করে। তাই আমি আমার গল্প কাউকে বলি না। আমি যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই।

শুধু শুধু কারো সাথে কথা বলে নিজের দুর্বিষহ দিনের কথা মনে করতে চান না আনোয়ারুল। অনেক জোরাজুরির একপর্যায়ে মুখ খোলেন এই অদম্য মানবসন্তান।

বলেন, তখন আমি ট্রাকে কাজ করতাম। ট্রাকের বিভিন্ন মালামাল ওঠানো নামানোই ছিলো আমার কাজ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের তিন বছর আগে একদিন দুপুর ১২টার দিকে ট্রাকে করে মাল নিয়ে যাচ্ছিলাম সাভারের দিকে। পথে সাভারের হেমায়েতপুরে একটা বাসের সাথে আমাদের ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে আমার ওস্তাদ (চালক) ঘটনাস্থলেই মারা যান। আমি বেঁচে গেলেও বাম হাত আর দুটো পা কেটে ফেলতে হয়।

কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা আনমনা হয়ে যান আনোয়ারুল। গলাটা ধরে আসার সাথে সাথে দু’চোখের কোণ বেয়ে নামতে থাকে নোনা জল।

আনোয়ারুল বলেন, ওই সময়ে মালিক আমাকে দেখভাল করেছে। চিকিৎসা করিয়েছে। পরে একটা দোকান করে দিতে চেয়েছিল গাবতলি স্ট্যান্ডে। আমি দোকান না নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।

তিনি বলেন, শুরুতে মানুষের সহযোগিতা চাইতাম। কিন্তু মানুষ খুব বকা দিতো। খারাপ খারাপ কথা বলতো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম পা না থাকুক, তবু নিজের আত্মসম্মানের পায়ে দাঁড়াব। তখন ঢাকায় ফিরে আসি। ছোটখাটো নানা কাজ (ব্যবসা) করতে থাকি।

’কি ব্যবসা করেন?’ জানতে চাই। জবাবে আনোয়ারুল বলেন, যখন যে ব্যবসা পাই। মাছ বিক্রি, ভাতের হোটেল, ফল বিক্রিসহ অনেক ব্যবসা করেছি। এখন আখের ব্যবসা করছি। দিনে ৩/৪শ’ টাকার বিক্রি করতে পারলে সংসার চলে। কিন্তু মানুষ খুব খারাপ। অনেকে বাকিতে খায়। কিন্তু পরে টাকা দিতে চায় না। কিছুদিন ভাতের হোটেলের ব্যবসা করেছি। তাতেও বাকি পড়েছে অনেক টাকা।

দুই ছেলের জনক আনোয়ারুল স্ত্রীকে নিয়ে কাওলা রেলস্টেশন লাগোয়া বস্তিতে থাকেন। ছেলেরা এলাকায় তাদের দাদির(আনোয়ারুলের মা) কাছে থাকে। সেখানে একটি কিন্ডার গার্টেনে পড়ালেখা করছে তারা। নিজের ভাগ্যের দোহাই না দিলেও ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন আনোয়ারুল। এখন ছেলেরা পড়া লেখা শিখে সমাজে একটা ভালো অবস্থান করতে পারলেই খুশি তিনি।

‘অনেকেই তো আপনার চেয়ে ভালো অবস্থায় থেকেও ভিক্ষা করে, আপনি কেন এতো সংগ্রাম করছেন?’ –এই প্রশ্ন রাখি তাকে। উত্তর দিতে দেরি হয় না আনোয়ারুলের: ‘মানুষের কাছে হাত পেতে চলার মধ্যে কোনো আত্মমর্যাদা নেই। আল্লাহ আমাকে যেভাবে রেখেছেন সেভাবেই নিজের চেষ্টায় বাঁচতে চাই। মাথাটা উঁচু করে বাঁচতে চাই। কারো কাছে হাত না পেতে বাঁচতে চাই। ’ 

বলে যাচ্ছিলেন, ‘এখন রেল লাইনের পাশে একটি চা-দোকান দেবো। এজন্য ১০ হাজারের মতো টাকা লাগবে। টাকা কোনোভাবে ম্যানেজ না করতে পারলে সমিতি থেকে লোন নেবো। ’

এদিকে সরকার ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করে স্বনির্ভরতা বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু অল্প সময়ে বেশি কামাই ও এক ধরনের নেশার কারণে এই পেশা ছাড়তে চায় না ভিক্ষুকরা।

এর সঙ্গে রয়েছে ভিক্ষাবাণিজ্য লালন-পালন সিন্ডিকেটের প্রলোভনও। সব মিলিয়ে একবার যে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে, সে আর এপথ ছেড়ে যেতে চায় না। অনেকেই আবার কৌশল বদলে পঙ্গুত্বের অভিনয় করে এক শ্রেণির পেশাদার ভিক্ষুকে পরিনত হয়।
পা নেই, তাই দাঁড়িয়েছেন আত্মমর্যাদার পায়ে আনোয়ার!- ছবি: বাংলানিউজ
আনোয়ারুলরা সত্যিকারের পঙ্গু হয়েও আত্মমর্যাদার কারণে কারো কাছে হাত পাততে রাজি নন। নিজেকে কারো দয়া বা করুণার পাত্র করতে রাজি নন। তাই নিজের শারীরিক অক্ষমতার বিরুদ্ধে জীবনপণ যুদ্ধ করে চলেছেন। যে যুদ্ধ কল্পনাকেও হার মানায়। আনোয়ারুল যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ উপন্যাসের নায়ক বুড়ো জেলে সান্তিয়াগোর মতো। যে বলেছিল, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত হতে পারে না। ’

সংশ্লিষ্ট কারোর নজরে না আসায় এতোদিনেও সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা ছদ্মবেশী পঙ্গু সেজেছেন তারা ঠিকই সরকারি অনুদান বাগিয়ে নিয়েছেন। পরে আবারো নতুন বেশে শুরু করছেন ভিক্ষাবৃত্তি। কিন্তু মাত্র ১০ হাজার টাকার অভাবে কি সৎ ব্যক্তিত্ববান, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আনোয়ারুলের ‘চা দোকানের’ স্বপ্নটা অধরাই থাকবে-- কোনো সিন্ডিকেটের সদস্য না হওয়ার কারণে? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? 

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫০ ঘণ্টা সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
এসআইজে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।