ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

মিনারাকে নিয়েই যতো আতংক

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
মিনারাকে নিয়েই যতো আতংক মা নূর আয়শার সঙ্গে মিনারা খাতুন। ছবি: বাংলানিউজ

আঞ্জুমানপাড়া, পালংখালি, উখিয়া, কক্সবাজার: নূর আয়শার মেয়ে মিনারা খাতুন। বয়স মাত্রই ১৪তে পড়েছে। ছোটবেলাতেই হারিয়েছে বাবাকে। তবে বাবা কোনো নৃশংস হত্যাকাণ্ড বা সাম্প্রদায়িক রোষানলের শিকার হয়ে নন, হারিয়ে গেছেন এমনিতেই। চার বছরের মিনারা ও নূর আয়শাকে ফেলে এমনিতেই সংসার ছেড়ে পালিয়েছিলেন মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ।

‘এই দশটি বছর মা-মেয়ের সংসার চলেছে একেবারেই খালি হাড়ের ওপর। মানুষের বাড়িতে কাজ-কাম করেই আমরা চলেছি।

বাবার কাছ থেকে পাওয়া তিন কানি জমিতে ছিলো বাড়ি। বাড়ির আঙ্গিনায় সব্জি-ফল চাষ করে, হাসঁ-মুরগী পালন করে, দুই মা-ঝিয়ের সংসার ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। ’ বলছিলেন নূর আয়সা।

মিয়ানমারের বুথেডং প্রশাসনিক এলাকার টমবাজার পার হয়ে নারায়ণ সাম পাড়াতে (গ্রাম) বাড়ি তাদের। গ্রামে যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন মগদের সম্মিলিত হামলা শুরু হলো, তখন তারাও বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধন্ত নেন।

‘ইচ্ছা ছিলো সকালেই সবার সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসবো। কিন্তু তা আর হয়নি। রাতেই বাড়িতে হামলা করে বসে মগরা। এরইমধ্যে ঘর থেকে অতিপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পেরেছিলাম। তবে সেজন্য বাড়ি পোড়াতে আসা মগদেরই একজন, আমাকে সহায়তা করেন। তিনি না থাকলে হয়তো মা-মেয়েকে পুড়েই মরতে হতো। ’- বলছিলেন নূর আয়শা। মিনারার হাতে লেখা বার্মিজ অক্ষরে তার নাম—‘মিনারা’তিনি বলেন, ‘বাড়ির পাশের ওই বৃদ্ধ মগ পুরুষটি এমনিতেও আমাদের অনেক সহায়তা করতেন। উনি একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মিনারা তার ছাত্রী ছিলেন। আমরা ঘর থেকে বের হওয়ার পরই পুরো বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েই আমাদের শেষ সম্বলটুকু পুড়তে দেখেছি। এরপর নিজের ও মেয়ের ইজ্জতের কথা চিন্তা করে জঙ্গলের পথ ধরেছি। ১৬দিন এক টানা পাহাড় ও জঙ্গলে হেঁটে বাংলাদেশে আসতে পেরেছি। একটুর জন্যও রাস্তায় দাঁড়াইনি। কোথাও বসি নাই। মেয়েটার হাত সব সময় ধরে রেখেছি। এখনো কেবল ওরে নিয়েই ভয়!’

আসার পথেই তাদের শেষ যে সম্বলটুকু ঘর থেকে আনতে পেরেছিলেন তা ও লুট হয়ে গেছে। সঙ্গী স্বজাতির কিছু কালপ্রিট এই অঘটনটি ঘটিয়েছে। একথা বলেই কেঁদে ওঠেন মিনারা বেগম।  

তিনি বলেন, ‘ভয়ংকর হিংসাত্মক মগদের হাত থেকে কিছু বাঁচাতে পারলেও সহযাত্রী রোহিঙ্গাদের হাত থেকে তা বাঁচাতে পারিনি। হয়তো তা তাদেরই বেশি প্রয়োজন ছিলো! তবে আমি এই জন্যই খুশি যে, আমাদের মা-মেয়ের ইজ্জতের কোনো ক্ষতি হয়নি!’

মিনারার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কোন ক্লাসে পড়ে সে। উত্তরে জানালো, ক্লাস থ্রি’র পরে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। তবে সে লিখতে পারে। পড়তেও পারে দেখে দেখে। এরপর তার দিকে নোটবুক ও কলম এগিয়ে দিলাম। বার্মিজ অক্ষরেই সে লিখলো তার নাম—‘মিনারা’।

তিন দিন হলো, আঞ্জুমান পাড়ায় এসেছেন নূর-আয়শা ও মিনারা খাতুন। চিংড়িঘেরের এক পাড়ে তুলেছেন পলিথিনের ছাপড়া। তার কোনাতেই একটি চুলা বানিয়েছেন। ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন চাল, ডাল, তেলসহ অনেক কিছুই। কিন্তু জ্বালানি কাঠের তো কোনো সংস্থান নেই, তাই রাঁধতে পারছেন না। ফলে চিড়া-মুড়িতেই চলছে ক্ষুধার সংস্থান।

এমনিতেই রাস্তা চলতে চলতে পায়ের নখ প্রায় খসে পড়েছে। পা-ফুলে উঠেছে। তাই কোথাও যেতে পারেন না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে মেয়েকে নিয়ে। ১৪ বছরের মেয়েটিকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখেন। ‘অজানা আশঙ্কায় ওকে রেখে কোথাও নড়তে পারি না’- বলছিলেন মিনারার মা নূর-আয়শা।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
আরএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।