২০ শতকে পদ্মা নদীর তীরবর্তী কেতুপুর সংলগ্ন জেলেপাড়ার মানুষের জীবনচিত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এঁকেছিলেন ঠিক এভাবে। তবে আজ পদ্মার পাড় নয়, লিখছি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীর তীরে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার কথা।
তবে মানিক বাবুর কেতুপুরে হয়তো দুটি পাড়া আছে। যার একটিতে কুবেরদের মতো সাধারণরা থাকলেও ক্ষমতাধর, টাকাওলা সমাজপতিরা থাকতেন অন্যপাড়ায়, ঈশ্বর ও থাকতেন সেই ভদ্র পল্লীতে, কিন্তু নাফ পাড়ের অস্হায়ী রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে এই ভেদাভেদ নেই। ফকির, ধনি, সবারই স্থান হয়েছে এখানে। তবে আর সব যেনো ঠিক সেই ২০ শতকের কেতুপুর গ্রামেরই মতো। এখানে আসার পথেই জন্মেছে অনেক শিশু। অনেকে জন্মেছে এখানে এসেই বা নোম্যান্সল্যান্ডে। কেউবা আসার পথে, তবু কারো মধ্যে নতুন শিশু আগমনের কোন আনন্দ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। শিশু আসাটাই যে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর নিয়ম! তবে এখন বর্তমান পরিস্থিতে সে জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন।
পালংখালি ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া গ্রামে চিংড়ি ঘেরের পাড়ে কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকায় রয়েছেন কয়েক হাজার শরণার্থী। এদেরই একজন। নাম আসাদ জামান। বয়স ১০ দিন। বাড়ি মিয়ানমারের বুথেডং এলাকার টম বাজার এলাকায়। বাংলাদেশে আসার পথেই নোম্যান্সল্যান্ডে জন্ম তার। আসাদ জামানের বাবার নাম আব্দুস সামাদ। সারাদিনই সাত সদস্যের পরিবারের জন্য ত্রাণ খুঁজে ফেরেন। মা রাজু বেগম ও দাদি রহিমা খাতুন, অন্যান্য ভাইবোনের সঙ্গে ১০ দিনের ছেলেটি আছে ঘের পাড়ের ৫ হাত বাই ৩ হাতের পলিথিনের চালার মধ্যে।
আসাদ জামানের দাদি রহিমা খাতুন বলছিলেন, ৫ রাত হলো তারা নোম্যান্স ল্যান্ড পার হয়েছেন। ৯ মাসের গর্ভবতী রাজুকে পেটে নিয়ে পেরুতে হয়েছে ভয়ংকর ১৬টি দিন। রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই তারা গভীর জঙ্গল ও পাহাড় বেয়ে হেঁটেছেন বাংলাদেশের পথে। যা ছিলো অকল্পনীয় এক পরিক্রমা। স্বাভাবিক বা সাধারণদের জন্যও ছিলো অসম্ভব কষ্টের। অথচ আসাদ জামানকে পেটে নিয়ে সেই পথে হেঁটেছেন ১৬ দিন। যার মধ্যে আকাশচুম্বী খাড়া পাহাড়ই ছিলো দুইটা। আর ছোট বড় মিলে সে সংখ্যা ১৬টি।
তিনি বলছিলেন, পথে কোথাও বসিনি। সারা রাস্তায় কেবল গুলির ভয়। মানুষের মিছিল। দিনরাত হেঁটেছি। এই ধকলে রাজু কাহিল হয়ে গেছে। গুড়িয়া পুতুর অবস্থাও ভালো না।
এই পরিবারের আশ্রয়ের পাশেই আর একটি রোহিঙ্গা পরিবারের বাস। তাদের তাঁবুর আকারও প্রায় সমান। এই তাঁবুর সদস্য সংখ্যা ১০ জন। এরমধ্যে শিশুর সংখ্যাই ৮ জন। যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির বয়স ১০ বছর ও ছোট ওমরের বয়স ৫ দিন। ওমরের জন্ম হয়েছে চলতি পথে পাহাড়ের ঢালে।
ওমরের মা ছোট খাটো গড়নের এক অনুপ্রেরণাদাত্রি শক্তিশালী নারী। নাম হাসিনা বেগম। ওমরকে পেটে নিয়েই তিনি বুথেডং থেকে রাজুর মতোই ১৫ দিন রাত দিন হেঁটেছেন। পথে প্রসব যন্ত্রণা হলে অন্যদের সহায়তায় ওমরকে প্রসব করেছেন। আবার অন্য বাচ্চাদেরও সামলেছেন। ওমর জন্মানোর পরই কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করেছেন। তিনি বলছিলেন, আমার আট পুতুয়া, ৪ মোরগ, ৪ মুরগী।
তিনি বলেন, গ্রামে ভালোই ছিলাম। ১০ কানি জমি ছিলো। সেগুলো নাড়ালেই ভালো থাকা যেতো।
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ও অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেয়া শিশুর সংখ্যা কেবল জাতিসংঘের হিসেবেই মোট শরণার্থীর ৬০ শতাংশ। সে হিসেবে কয়েক লাখ শিশু এসেছে বাংলাদেশে। প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে কয়েকটি করে শিশু। এরা ক্ষুধা-জ্বরায় আক্রান্ত।
এদের শিক্ষা নেই, চিকিৎসাও নেই। তবু শিশু আসাটাই যেনো রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর নিয়ম! তবে এখন বর্তমান পরিস্থিতে সে জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭
আরএম/জেডএম