এভাবে রাস্তা পার হওয়াটা যে বেশ ঝুঁকির ছিল, তা বোঝা গেল পার হওয়ার পর তার পেছন ফিরে চাওয়াতেই। ফয়জুরের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও এভাবে কেন রাস্তা পার হলেন?’ খুব সংক্ষিপ্ত আকারে উত্তর দিলেন তিনি, ‘হাতে সময় কম, আর ওভারব্রিজে ওঠা-নামাও কষ্ট, তাই।
শুধু ফয়জুর রহমান নন, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা মতে, ফুট ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হন। যার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জনগণ মনে করে-- ফুট ওভারব্রিজে ওঠানামা একটি কষ্টকর ব্যপার এবং তারা খুব কম সময়ে রাস্তা পার হতে চায়।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফুট ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও জনগণ চলন্ত গাড়ির মাঝ দিয়েই এলোমেলোভাবে রাস্তা পার হচ্ছে। কয়েক মিনিট সময় বাঁচানো বা একটু কষ্ট না করার জন্য তারা নিচ্ছে জীবনের ঝুঁকি। আর এ ধরনের নিয়ম লঙ্ঘন বেশি দেখা যায় রাজধানীর শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, বনানী এবং মিরপুরের মতো ব্যস্ত এলাকাগুলোতে।
এ ব্যাপারে মিরপুরের পথচারী অব্দুল হামিদ বলেন, ফুট ওভারব্রিজটা ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না, তবে জানি এটা উচিত। কিন্তু পথে চলতে চলতে গাড়িগুলোকে হালকা পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হওয়া যায় বলেই ওভারব্রিজে আর ওঠা হয় না।
এ ধরনের নিয়ম লঙ্ঘনে অবশ্য বিরক্ত অনেক সচেতন নাগরিক। তাদেরই একজন পথচারী খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। এদের সাইকোলজি বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কী এক অদ্ভুত কারণে আমরা ফুট ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাস্তার মাঝখান দিয়ে বড় বড় গাড়ির ফাঁক-ফোকর গলে পার হতে পছন্দ করি, ঠিক বুঝি না! এমনকি অনেক বাবা-মাকেও দেখি, তাদের ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ফুট ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে নির্বিকারভাবে রাস্তা পার হচ্ছেন!
এমনভাবে রাস্তা পারাপারে যেমন রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, তেমনি এর ফলে অনেক সময় সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটেরও। এমনকি এই বেপরোয়া লোকদের কারণেই রাস্তার গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সমস্যা পোহাতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের।
বাংলামোটর মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ শফিকুল ইসলামই বললেন এমন কথা। তিনি বলেন, এদের কথা আর বলবেন না ভাই। ওভারব্রিজ পড়ে আছে ফাঁকা, তবু এরা ব্যস্ত সড়কের মাঝ দিয়েই রাস্তা পার হবে। মানুষগুলোর এমন এলোমেলো চলাচলের জন্য আমরাও ঠিকভাবে কাজটা করতে পারি না। গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণে ঝামেলা হয়। এরা হরহামেশা এসে ব্যস্ত সড়কে ঢুকে পড়ে। সামান্য সিগন্যালের জন্যও অপেক্ষা করে না।
কথা বলতে বলতেই আঙুল তুলে দেখান ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে থাকা একজনকে, ওই যে দেখেন, দু’টো গাড়ির মাঝ দিয়ে মানুষটা কিভাবে রিস্ক নিয়ে যাচ্ছে! এখন যদি দু’টো গাড়ির ধাক্কায় মানুষটা চেপ্টা হয়, তাহলে এই দায়ভার কে নেবে!
পুলিশের সুরেই কথা বলেন বলাকা পরিবহনের চালক হাফিজুল ইসলাম। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, লোকজন রাস্তার মাঝ দিয়ে পার হলে আমাদেরও গাড়ি চালাতে বেশ অসুবিধা হয়। ওভারব্রিজ ব্যবহার করবে না, আবার সড়ক পার হওয়ার সময় বাসের একটু ধাক্কা লাগলেই শুরু হবে মহাসড়ক অবরোধ। তখন যতো দোষ সব আমাদের চালকদের। তারা আইন মানবে না, অথচ খেসারত দিতে হবে আমাদের। ’
যত্রতত্র রাস্তা পারাপারে জেল-জরিমানার আইন থাকলেও তা কেন প্রয়োগ হচ্ছে না জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশ শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কোন লাভ নেই! বহুবার বাংলামোটর মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়েছে। অনেককে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন পরে আবার যা তাই! আমরা আসলে নিজের ভালোটা বুঝতে চাই না। ’
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক জুবাইদা খানম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রাস্তার চলন্ত গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হতে ৫-৭ মিনিট রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু ২-৩ মিনিটে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে পারি না। এর জন্য আমাদের মানসিকতাটা পরিবর্তনের প্রয়োজন। সঙ্গে একটু সুব্যবস্থারও।
তিনি বলেন, লক্ষ্য করুন কোথায় কোথায় আইনটা বেশি অমান্য হচ্ছে! ক্যান্টনমেন্টের দিকে কিন্তু এমনটা নেই। সেখানে ঠিকই সবাই ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করছে। ফার্মগেটের মূল ওভারব্রিজটা দেখুন, ওটাও সবাই ব্যবহার করছে। কেন? কারণ তাদের কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই। ওই জায়গাগুলোতে রাস্তার মাঝে কাঁটাতারের রেলিং দেওয়া। রাস্তা দিয়ে পারাপারের কোনো ব্যবস্থা সেখানে নেই। যেখানে বিকল্প আছে, মানুষ তো সে সুযোগ নেবেই।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭
এইচএমএস/এইচএ