পুরো শাহপরীর দ্বীপ তখন মিয়ানমারের নাগরিকে পরিপূর্ণ। তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংস্থা, সংগঠন আর ব্যক্তি পর্যায়ের সহায়তার চিত্র।
এটা নিশ্চিত বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বঞ্চিত, নির্যাতিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় কেউই কবি আবুল হাসানের নাম শোনেননি। পড়েননি তার 'জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন' কবিতার বিখ্যাত লাইন- ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না। ’ তবে রোহিঙ্গাদের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে কীভাবে যেনো মিলে যায় এ কবিতার ভাবার্থ। বরং এর সঙ্গে যোগ করা যায় মৃত্যু ভয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ভাবনাকে। রোহিঙ্গাদের সারাজীবন অং সান সুচি ও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রসিকে (এনএলডি) ভালোবেসে সমর্থন করে প্রতারিত হওয়ার কষ্টের কথা।
যে নেতা ক্ষমতায় গেলে তাদের কষ্ট দূর হবে বলে ভেবেছিলেন রোহিঙ্গারা! তাই হয়তো আবুল হাসানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে পারেন, মৃত্যু আমাকে নেবে, সুচি আমাকে নেবে না। এ প্রসঙ্গ এজন্যই এখানে প্রযোজ্য যে প্রায় আধা ডজন রোহিঙ্গার সঙ্গে সকাল থেকেই পরিচয় হয়ে গেছে, যারা সুচির দল করে, আন্দোলন করে জেল খেটেছেন, নির্যাতনের যাতায় পিষ্ট হয়েছেন। অথচ সুচির হাতেই তারা ঘরছাড়া, দেশ হারা।
আবার তাকানো নাফের ওপারে। যেখানে ধোয়ার কুণ্ডলি। পালিয়ে মানুষের প্রায় সবার গল্পই এক। সবাই অগ্নিসংযোগ, স্বজন হত্যা, ধর্ষণের বর্ণনা দিচ্ছেন। আগুনের দিকে আবার তাকাই। মনে পড়ে বিবিসির সাংবাদিক জোনাথন হেড'র দেখা গত সপ্তাহের মংডু শহর দেখার গল্প।
তিনি লিখেছিলেন, জগে করে পেট্রোল নিয়ে বৌদ্ধ তরুণদের অগ্নি সংযোগ ও তলোয়ার, গুলতি নিয়ে পাহারা দেওয়ার কথা। আর এসবেই যে সে দেশের সেনাবাহিনীর হাত আছে, তা ওই তরুণরা তাকে বলেছিল। সামনে যে সারিবদ্ধ ধোঁয়ার কুণ্ডলি তাও ওই মংডু জেলারই বিভিন্ন গ্রাম। যদিও বোবা নাফ নদী তাদের নীরবেই সমান্তরালে এনে ফেলেছে।
জেটিতেই দেখা রহিমউল্লার সঙ্গে। স্ত্রী নুরজাহান বেগম ও পরিবারের আরও ৫ সদস্য নিয়ে তিনি গরুর ট্রলারে করে এপারে এসেছেন। গেলো সপ্তাহেই তার চার ছেলেকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ জঙ্গলে সবাই মিলে পালিয়ে থেকে আজই ভোরে বাংলাদেশে এসেছেন।
তিনি জানালেন, পুড়ছে নাজির ডেইলের সুদা পাড়া, পিলা ঢং পাড়া, নুরুল্লা পাড়াসহ অসংখ্য গ্রাম।
রহিমউল্লাহই কুণ্ডলি পাকিয়ে ওঠা ও গতকাল ঝলসে যাওয়া গ্রামগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন। গতকাল পুড়ে যাওয়া একটি এলাকার নাম কইন্যাপাড়া। যেখানে চার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারের বসবাস ছিল। যার পুরোটাই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দূর থেকেই সে অপকর্মের চিহ্ন শত শত ঝলসানো গাছ চোখে পড়ে। পাশেই আর একটি বসতির নাম ঢংখালি। সেটাও পুড়েছে শনিবার। সেখানেও ১০ হাজার মানুষের বাস ছিলো।
তবে বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের প্রায় সবাই এরইমধ্যে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন বলে জানান তিনি।
জেটিতেই দেখা মিললো ৯১এর সহিংসতার শিকার হাসানের সঙ্গে। মংডুর গোজারবিল এলাকার এক সময়ের বাসিন্দা সে। ৯১ সালে বাংলাদেশে এসে আর ফেরত যাননি হাসান। শাহপরীর দ্বীপের জাইল্যা পাড়ায় বিয়ে করে থেকে গেছেন বাংলাদেশে। মিয়ানমারের নাইক্ষন দ্বীপে আটকা পড়েছেন তার স্বজনরা। আজই তাদের বাংলাদেশে আসার কথা। কিন্তু নৌকার অভাবে আসতে পারছেন না এপারে। এপারের নৌকা ও দিনের বেলা গুলির ভয়ে তাদের আনতে ওপারে যেতে পারছে না।
সামনেই হাসান ফোনে যোগাযোগ করে ওপার থেকে জানতে পারলেন প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা আটকে আছেন নাইক্ষন দ্বীপে। হাসান জানালেন, রাত্রিবেলা ফিরবেন ওই আটকা পড়ারা।
এদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দিকে বদর মোকামের বাইরে জেগে ওঠা গোলার চরে দেখা গেলো শতশত মানুষের অস্তিত্ব। নৌকায় করেই তারা ভোরে সেখানে এসে নেমেছেন বলে জানালো অটো চালক কালাম। ওপথে আসা রোহিঙ্গাদের বিজিবি রিসিভ করে ক্যাম্পের দিকে পাঠায় বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের এক সদস্য অবশ্য জানালেন, এখন আর রিসিভ করা বা প্যুশব্যাক করার সুযোগ নেই। চারদিক থেকে যে যেভাবে পারছে, ঢুকে পড়ছে।
শাহপরী দ্বীপের কাটা রাস্তার সাবরাং পয়েন্টে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করছে তাবলিগ জামাতের সদস্যরা। তারা রোহিঙ্গাদের বোট ভাড়া ও ক্যাম্প বা টেকনাফে পৌঁছোবার খরচ দিচ্ছেন। এই দলের সদস্য আছাদ বলছিলেন, শাহপরী দ্বীপ দিয়ে আজই সবচেয়ে বেশি মানুষ আসছেন। সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এর সংখ্যা ছিলো ৩০ হাজারের মতো। বিকেলে এ সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। সোমবারও এমন সংখ্যক মিয়ানমারের নাগরিক আসতে পারে বলে তারা খবর পেয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
আরএম/এএ