ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

যৌতুক ও নির্যাতনের বলি হয়ে কিশোরী বধূর মৃত্যু

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৭
যৌতুক ও নির্যাতনের বলি হয়ে কিশোরী বধূর মৃত্যু

লক্ষ্মীপুর: ‘আমরা পরস্পরকে না দেখে এক মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে পারি না। পরস্পর পরস্পরকে জীবন সঙ্গী হিসেবে না পেলে আমাদের জীবনযাপন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে-অপরের সুখে-দুঃখে সাথী হবো। চিরদিন একে-অন্যকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবো। কেউ-কাউকে ছেড়ে যাবো না’।

প্রেমের প্রতিশ্রুতি ও বিবাহ সংক্রান্ত ঘোষণায় এমন কথা থাকলেও স্বামী মো. স্বপন (২৫) কথা রাখেননি। স্বামী, শাশুড়ি ও ননদদের চরম অপমান, মানসিক যন্ত্রণা, নির্যাতন ও যৌতুকের বলি হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে কিশোরী গৃহবধূ হোসনেয়ারাকে (১৭)।

বৃহস্পতিবার (২৩ আগস্ট) হোসনেয়ারার বাড়ি গিয়ে বাবা-মা ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কিশোরী গৃহবধূর করুণ মৃত্যুর কথা। নিহত কিশোরী গৃহবধূ হোসনেয়ারা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর লরেন্স ইউনিয়নের চর মার্টিন গ্রামের আলী হোসেনের মেয়ে।
 
নিহতের বাবা আলী হোসেনসহ স্বজনরা জানান, ২০১৩ সালে কালকিনি ইউনিয়নের চর শামছুদ্দিন গ্রামের মো. ছিদ্দিকের ছেলে স্বপনের সঙ্গে হোসনেয়ারার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কের এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ২৯ জুন তারা পালিয়ে আদালতে গিয়ে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে করে। ওই সময় তার বয়স ছিলো ১৩ বছর। তখন সে স্থানীয় তোরাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে যায় হোসনেয়ারা। কিছুদিন না যেতে শুরু হয় শাশুড়ি, ননদ ও স্বামীর মানসিক যন্ত্রণা। এরইমধ্যে বিদেশ যাওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে স্বামী স্বপন আদায় করে ১ লাখ টাকার যৌতুক। দাবি করে আরও একভরি স্বর্ণালংকার।

এদিকে, শাশুড়ি খাদিজা বেগম, ননদ নাজমা ও আছমা অকারণে প্রায় প্রতিদিন গালমন্দ ও মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকে হোসনেয়ারাকে। খাবার না দেওয়ার অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধে। গত মে মাসে হোসনেয়ারার পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। জন্মের পর থেকে ওই শিশু অবৈধ বলে প্রচার করতে থাকে স্বামী, শাশুড়ি ও ননদরা। দীর্ঘদিন ধরে এমন অপবাদ সইতে না পেরে ১২ আগস্ট সে রাগে-অভিমানে বাবার বাড়িতে চলে আসে। ১৫ আগস্ট মঙ্গলবার স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে গেলে সে যাবে না বলে জানায়। পরে স্বামী স্বপন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে স্ত্রীকে সুখে রাখার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যায়। ওই রাতে কিশোরী গৃহবধূকে মারধর করে স্বামীসহ শশুরবাড়ির লোকজন। রাতে খাবারও দেয়নি।  

এসব সইতে না পেরে রাগে-ক্ষোভে হোসনেয়ারা আগাছানাশক ওষুধ (বিষ বিশেষ) পান করে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়লে শশুরবাড়ির লোকজন তাকে চিকিৎসা করায়নি। পরের দিন ১৬ আগস্ট হোসনেয়ারার বাবা আলী হোসেন শশুরবাড়িতে চিকিৎসক নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করায়। ২০ আগস্ট তাকে কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয় স্বামী। ভর্তি না করিয়ে কিছু ওষুধ কিনে তাকে ফের বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই রাতেই হোসনেয়ারার মৃত্যু হয়। ২১ আগস্ট সকালে পুলিশ খবর পেয়ে মরদেহ উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে ২২ আগস্ট দাফন করা হয় তাকে।

স্বজনরা জানিয়েছেন মরদেহ গোসলের সময় পিঠে ও কোমরের নিচে কালো জখমের চিহ্ন দেখা গেছে।

মা ছকিনা বেগম বলেন, আমার মেয়েকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। শশুর বাড়ির লোকজন আমাদেরকে মৃত্যু খবর শোনায়নি; পাশের বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে গিয়ে দেখি মেয়েকে লেপ দিয়ে ঢেকে রেখেছে। এসময় স্বামী ও ননদরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। চার মাস বয়সি নাতিকে লুকিয়ে রাখে।

বাবা আলী হোসেন বলেন, আমার মেয়েকে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এ মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করবো। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই।

এ ব্যাপারে জানতে স্বামী স্বপন ও শাশুড়ি বিবি খদেজার মোবাইলে একাধিকবার কল করেও ফোন বন্ধ থাকায় তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার পর শশুর বাড়ির লোকজন পলাতক থাকায় তাদেরকে আটক করে জিজ্ঞাসা করা সম্ভব হয়নি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৪০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৭
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ