হয়তো কেউ বানের পানি মাড়িয়ে দোকানে আসতে পারেন। এসে যদি ফিরে যান তাহলে ক্ষতিটা তারই বেশি।
কিছুটা দূরে এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল মুদি দোকানি রঞ্জু শেখ দোকানে বসেই দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। তার দোকানের ভেতরে পানি। ইট দিয়ে চৌকি উঁচু করে তাতে মালপত্র রেখে বিক্রি করছেন তিনি। দোকানের কাঁচামালগুলো বিক্রি করতে না পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণে বাধ্য হয়ে পানির মধ্যে বসে দোকান চালাচ্ছেন। তবে পানি মাড়িয়ে গ্রাহক তেমন আসছেন না। বুধবার (২২ আগস্ট) দুপুরে কাজিপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকুরিয়া হাট-বাজার ঘুরে আর কোনো দোকান খোলা পাওয়া গেলো না। খোলা থাকবেই বা কী করে, পুরো হাট-বাজারটিই বন্যার পানিতে নিমজ্জিত।
হাটটি পেরিয়ে মাইজবাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর এলে দেখা গেলো, পলিথিনের ছাউনি তুলে সাত/আটটি দোকান পাতা হয়েছে। সেখানকার একটি চায়ের দোকানে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুস সালাম ও লুৎফর রহমান। বাংলানিউজকে তারা বলেন, ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকুরিয়া হাট-বাজারটি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর ছাড়াও বগুড়া জেলার ধুনট ও সারিয়াকান্দি উপজেলার সীমান্তবর্তী মানুষের মিলনস্থল। কাজিপুরের মাইজবাড়ী, বিলচতল, শিমুলদাইড়, ছালভরা, কুনকুনিয়া, মেঘাই, চকপাড়া, শ্রীপুর, হাটগাছা, সোনামুখী, বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ভান্ডারবাড়ি, মাধবডাঙ্গা, সরকারপাড়া, মাটিকোড়া, সারিয়াকান্দি উপজেলার নারায়নপুর, পুকুরিয়া, নিউ সারিয়াকান্দি ও গোসাইবাড়ীসহ অন্তত অর্ধশত গ্রামের মানুষ এ হাটেই কেনাবেচা করে থাকে। রোববার ও বৃহস্পতিবার হাটবার ছাড়াও প্রতিদিন সকাল-বিকেল এখানে বাজার বসে। এ হাটটির ওপর এ অঞ্চলের অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভরশীল।
কিন্তু বিগত দেড়মাস ধরে হাটটি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় চরম দুর্ভোগে রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও এখনো ঢেঁকুরিয়া হাটটিতে হাটু পানি। পানি পুরোপুরি নামতে কমপক্ষে আরও এক সপ্তাহ এবং কাঁদা শুকিয়ে হাট বসার উপযোগী হতে অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। সব মিলিয়ে দুই মাস ধরেই হাট-বাজার বসার অনুপযোগী থাকবে।
বাঁধের ওপর কথা হয়, ওই হাটের কাপড়ের দোকানি মজনু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, হাটের মইধ্যে পানি, কাপড় কিনব্যার আইসপো কেডো। ঈদের জন্য নতুন জামা-প্যান্ট দিয়্যা দোহান ভইর্যা ফালাইচি। কিন্তু যে অবস্থা দেইখত্যাচি, তাতে ঈদের আগে দোহান খোলাই যাইবো না। কাপড়গুলো যে কিভাবে বেচমু, তাই চিন্তা কইরত্যাছি।
মিষ্টির দোকানদার বিমল কুমার বললেন, দোকানেও পানি, বাড়িতেও পানি। ব্যবসা বন্ধ কইর্যা পুঁজি ভাইঙ্গা খাইত্যাচি। আগে বিপদ তো উদ্ধার অইক। তারপরে ব্যবসার চিন্তা করমুনি।
বাদাম বিক্রেতা গোলাম রব্বানী, কাপড়ের দোকানদার, মুকুল, মোহাম্মদ ওষুধের দোকানের মালিক মিনু ও রুহুলসহ অনেকেই এগিয়ে এসে জানালেন হাট বন্ধ থাকার কারণে তাদের দুরাবস্থার কথা।
তারা বলেন, এ অবস্থা নতুন নয়। প্রতিবছর বন্যাতেই এ হাটটি ডুবে যায়। আর দুই থেকে তিনমাস ধরে ব্যবসা বন্ধ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। এতে অনেকের পুঁজি শেষ হয়ে যায়। বন্যা নেমে গেলে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধার নিয়ে আবারও দোকান চালু করেন তারা। সামনে ঈদ। ঈদ উপলক্ষে এ হাটে সবচেয়ে বেশি বিকিকিনি হয়। ঈদের আগে হাটটি প্রস্তুত না হলে প্রায় ১০ হাজার ক্রেতা-বিক্রেতারা চরম বিপাকে পড়বেন।
হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান মুকুল বাংলানিউজকে জানান, এ হাটটিতে প্রায় ৩৫০টি স্থায়ী দোকান ও ৭০০টি অস্থায়ী দোকান রয়েছে। প্রতি হাটে আট/১০ হাজার টাকা খাজনা আদায় হয়। এছাড়া প্রতিদিন বাজার থেকেও খাজনা আদায় হয়। কিন্তু বিগত দেড়মাসে ১২টি হাট বারে হাট বসেনি। আরও অন্তত চারটি হাট বসবে না। এছাড়া বাজার তো বন্ধ রয়েছেই। এতে যে টাকায় হাটের ইজারা নিয়েছিলাম সে মূলধন ফিরে আসা নিয়েই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় মাইজবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বাংলানিউজকে জানান, চলতি বন্যায় ঢেঁকুরিয়া হাট-বাজারটি পানিতে নিমজ্জিত থাকায় এ অঞ্চলের মানুষের কোরবানির গরু-কেনাবেচা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। শুধু এ হাটটি নয়, হাটের আশপাশের পাঁচটি মসজিদ ও তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পানিতে নিমজ্জিত।
তিনি জানান, হাটের উত্তর-পূর্বপাশে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে পারলে বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে হাটটি। পাশাপাশি স্বস্তি ফিরে পাবেন হাটের ক্রেতা-বিক্রেতারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৭
এসআই