ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অক্ষম হ্যামারে বন্ধ পদ্মাসেতুর পাইলিং!

সাব্বির আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
অক্ষম হ্যামারে বন্ধ পদ্মাসেতুর পাইলিং! অক্ষম হ্যামার/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: পদ্মার গভীরে গত ১০ আগস্ট থেকে একটি পাইলেও আঘাত হানতে পারেনি তিনটি হ্যামারের একটিও। ফলে দশদিন ধরে বন্ধ রয়েছে স্বপ্নের পদ্মাসেতুর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ খরস্রোতা পদ্মার গভীরে পাইল ড্রাইভিং।

পদ্মাসেতুর প্রকৌশলীরা জানান, পদ্মার অতল গভীরতা আর স্রোতের ভয়াবহতা মাড়িয়ে খুটি গাঁথতে আনা হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিসম্পন্ন ৩ হাজার কিলোজুলের হ্যামার। কিন্তু নদীগর্ভে পাইলিং করতে না পেরে শুরুতেই আত্মসমর্পণ করে হ্যামারটি।

২ হাজার কিলোজুলের আরও একটি হ্যামার ৩ থেকে ৪টি পাইল গভীরে নিয়ে রণভঙ্গ দেয়।

প্রকৌশলীরা তখন ভরসা রাখেন ২ হাজার ৪০০ কিলোজুলের হ্যামারে। এটি কাজ খানিকটা এগিয়ে নিতে সহায়তা করে বটে। তবে প্রতি ১০টি পাইল গভীরে নেওয়ার পর এটিও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন ফের সক্রিয় করতে প্রয়োজন হয় এর রক্ষণাবেক্ষণের। এ অবস্থায় সেটির সঙ্গে আরেকটি হ্যামার এসে যোগ দিয়েছে। তবে ১ হাজার ৯০০ কিলোজুলের সর্বশেষ হ্যামারটি এখনও কাজে নামেনি।

এ নিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণে ৪টি হ্যামার এসেছে। ৩ হাজার ৫০০ কিলোজুলের আরও একটি হ্যামার আগামী সেপ্টেম্বর মাসে এসে কাজে যোগ দেবে। সব মিলিয়ে পদ্মায় হ্যামার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৫টিতে। তবে সক্রিয় মাত্র ৩টি!
 
শনিবার (১৯ আগস্ট)  সারাদিন পদ্মার দুই পাড় মাওয়া-জাজিরায় কর্মহীন পড়ে থাকতে দেখা গেছে হ্যামারগুলোকে।

যেসব হ্যামার দাঁড়িয়ে প্রতি সেকেন্ডে সজোরে ‘ঢম-ঢম’ আঘাত হানতো, সেগুলোই এখন নদীতে ভাসমান বার্জে গা হেলিয়ে সূর্যস্নানে ব্যস্ত।
 অক্ষম হ্যামারে বন্ধ পদ্মাসেতুর পাইলিং!/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মাসেতুর ৩৩নং পিয়ারের পাশে পড়ে আছে ৩ হাজার কিলোজুলের হ্যামার। ৪১নং পিয়ারের পাশে আছে ২ হাজার ৪০০ কিলোজুলের হ্যামার। আর ২ হাজার কিলোজুলের হ্যামারটি পুরোপুরিই বিকল। ১৬নং পিয়ারের কাছে বসে আছে সর্বশেষ আনা ১ হাজার ৯০০ কিলোজুলের হ্যামার। আজ-কালের মধ্যে তার কাজে যোগ দেওয়ার কথা। তার সক্ষমতা কতোটুকু- তাও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
 
পদ্মাসেতু সূত্র জানায়, জাজিরা প্রান্তে পাইল ড্রাইভে গতি আনতে গত মে মাসের শুরুতে আনা হয়েছিলো ৩ হাজার কিলোজুলের হ্যামার। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে এর প্রতি প্রত্যাশাও জেগেছিলো বেশি। কিন্তু আশার গুঁড়ে বালি দিয়ে এটি এখন বিকল। জার্মানির মিউনিখে তৈরি হ্যামারটি দিয়ে আর কাজ এগোনো যায়নি।
 
এর আগে পদ্মাসেতুতে যে দু’টি হ্যামার ব্যবহৃত হচ্ছিলো- তার একটি ২ হাজার ৪০০ ও অন্যটি ২ হাজার কিলোজুল শক্তির। সেগুলোও এখন ঠিক নেই। ২ হাজার কিলোজুলের হ্যামারটির মাঝখানের দণ্ড ভেঙে গেছে। এটি আর ঠিক হওয়ার আশা নেই- বলছেন সেতুর প্রকৌশলীরা।

সব মিলিয়ে এসব হ্যামার এ পর্যন্ত ৪৯টি পাইল গভীরে নিয়েছে। যাতে তারা ৯ লাখ ২০ হাজার বার আঘাত করে নদীতে দণ্ডায়মান পাইলে।  
 
সেতু প্রকৌশল সূত্র জানায়, ২ হাজার ৪০০ ও ৩ হাজার কিলোজুলের হ্যামারের মেরামত শুরু হচ্ছে শিগগিরই। এগুলো এ মাসের শেষদিকে ফের কাজে যোগ দিতে পারবে বলে মত মেরামত প্রকৌশলীদের।
 
সেতু বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, পদ্মায় পাইল গভীরে নিয়ে যাওয়া এ সেতুর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের। নদীর তলদেশে মাটির গঠন খুবই জটিল। যে বৈচিত্র্য বিশ্বের অন্য কোনো সেতুর পাইল গাঁথতে দেখা যায়নি। এ কারণে এ সেতুর পাইল ডিজাইনে বার বার পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
 
যমুনাসেতুর সঙ্গে তুলনা করে তারা আরও জানান, যমুনাসেতুতে একটি খুঁটির নিচে মাত্র ৩টি করে পাইল। আর পদ্মায় একটি খুঁটির নিচে ৬টি করে পাইল। যমুনাসেতুতে পাইলের গভীরতা ছিলো মাত্র ৮০ মিটার। আর এখানে গভীরতা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ১৩০ মিটার। যমুনাসেতু তৈরিতে সব পাইলে মোট ৮ লাখ বার চাপ দিয়েছে হ্যামার। যেখানে পদ্মাসেতুর এ পর্যন্ত মাত্র ৪৯টি পাইল গভীরে নিতেই ৯ লাখ ২০ হাজার বার চাপ দিতে হয়েছে হ্যামারগুলোকে।
 
চায়না মেজর ব্রিজ (এমবিইসি) প্রকৌশলীদের বর্ণনামতে, কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে বার্জে তুলে পাইল নিয়ে আসার পর তা গোলাকার গাইডিং ফ্রেমে তোলা হয়। গাইডিং ফ্রেমের হাইড্রোলিক জ্যাকের সাহায্যে তা ১/৬ অনুপাতে স্ট্যাবল করা হয়। তারপর ক্রেনের সাহায্যে হ্যামার দিয়ে পাইল পদ্মার তলদেশে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়।

এটিই হ্যামারের কাজ। কিন্তু এ কাজ বার বার থমকে গেছে হ্যামার জটিলতায়। সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে তাই বেশ ভোগাচ্ছে হ্যামারগুলো।
 অক্ষম হ্যামার/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
এদিকে পরে আরও যে দু’টি হ্যামার আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো, তার একটি গত ১৩ আগস্ট পদ্মাপাড়ে চলে এসেছে। অ্যাসেম্বিলিং শেষে এটি এখন কাজে নেমে পড়বে দু’একদিনের মধ্যেই।

আর ৩ হাজার ৫০০ কিলোজুলের বাকি হ্যামারটি দেশে আসবে সেপ্টেম্বরের শেষে।

মূল পদ্মা নদীতে ১৫০ মিটার পর পর ৪২টি পিলারের ওপর নির্মাণ করা হবে ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মাসেতু।

পিলারের পাইলগুলো ইংরেজি উল্টো ‘ভি’ অক্ষরের মতো হবে। ভূমিকম্পসহ নদীর পানির ধাক্কা মোকাবেলায়ই বাঁকা করে ড্রাইভিং হচ্ছে।
 
এছাড়া দেড় কিলোমিটার করে উভয়পাড়ে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর জন্য আরও ২৪টি পিলার থাকবে। সেতুর ৪২টি পিলারে মোট ২৪০টি এবং দু’পাড়ের ১২টিতে ২৪টি পাইল বসানো হবে। সর্বমোট ২৬৪টি পাইলিং হবে।
 
পাইলিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা পিলারের ওপর বসবে স্প্যান। যেসব স্প্যানের নিচে থাকছে রেললাইন ও ওপরে সড়ক।

দ্বিতল পদ্মা বহুমুখী সেতুর পুরোটা হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর ওপরের তলায় থাকবে চারলেনের মহাসড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করে সেতু চালুর কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৭
এসএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।