যা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে অকৃপণভাবে।
ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এই পাঠশালায় মনিরাজ, জটডুমুর, রক্তচন্দন, লালআতা, ডেগোফল, কাজুবাদাম, কনকচাঁপা, কালাপাহাড়, লালসাগর, মৌসন্দেশ কলা, কালিবগ কলা, বট, বাবলা, শিব জটা, লাল সেজে, করবী, লালজবা, টগর, কাঞ্চন, কামিনী, চাঁপা ফুল, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, চুইঝাল, জাফরান, পেপুল, কাঁটানটে, আমরুল, তেলাকুচ, ডুমুর, আতাড়ি পাতাড়ি, লতামুক্তঝুরি, শম্ভুলতা, কৃষ্ণতুলসি, দুধলতা, শিয়াল কাঁটা, অনন্ত মূল, পাপড়া, শিমুল, জয়তুন, উলটকম্বল, তরুপ চন্দাল, গদপান, সাদা ধুতুরা, জষ্ঠিমধু, ডায়াবেটিস গাছসহ ২০৬ প্রজাতির ওষুধি, ৮৩ প্রজাতির ফলজ, ৪৪ প্রজাতির আম, ১৭ প্রজাতির কলা, ৩৩ প্রজাতির সবজি ও অচাষকৃত সবজি, ২৩ প্রজাতির মসলা জাতীয় উদ্ভিদ, ২৪ প্রজাতির ফুল, ২৩ প্রজাতির বনজ এবং সুন্দরবনের নয় প্রজাতির বৃক্ষের সমাহার রয়েছে।
আর এই পাঠশালায়ই এখন বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক সুতোয় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। স্থানীয় তুজলপুর কৃষক ক্লাবের সভাপতি ইয়ারব হোসেন তার লিজ নেয়া ১৮ কাঠা জমিতে গড়ে তুলেছেন গাছের পাঠশালা নামক এই ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা কেন্দ্রটি। যা সমগ্র জেলায় ইয়ারবের গাছের পাঠশালা নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ইয়ারব হোসেনের গাছের পাঠশালায় ছোট ছোট বোর্ডে লেখা রয়েছে প্রতিটি গাছের নামসহ গুণাগুণ। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য পাঠশালার এক পাশে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ বৃক্ষ। সুন্দরবনের বৃক্ষ পরিচিতির জন্য রয়েছে সুন্দরবন কর্নার। গোটা পাঠশালাকে বিলুপ্ত প্রায় ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছের সংরক্ষণাগার বললেও ভুল হবে না। স্থানীয়দের পাশাপাশি দূর-দূরান্তের মানুষও প্রতিদিন গাছের পাঠশালায় ঘুরতে আসেন। যেন এক খণ্ড বিনোদন কেন্দ্র। একই সঙ্গে গাছের পাঠশালার পরিচালক ইয়ারব হোসেনের কাছ থেকে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় গাছ। যারা শুধুই বেড়াতে আসেন তাদের উপহার হিসেবে দেয়া হয় ফলজ বৃক্ষের চারা।
সরেজমিন দেখা যায়, পাঁচ শতাধিক ওষুধি, ফলজ ও বনজ বৃক্ষ দীপ্তি ছড়াচ্ছে গাছের পাঠশালায়। একই সঙ্গে এই পাঠশালায় কেঁচো কম্পোস্ট ও বিভিন্ন ধরনের জৈব সার তৈরি, ফেরোমোন ফাঁদের বাস্তব ব্যবহারের প্রদর্শনীও রয়েছে। একদল মানুষ সেখানে রয়েছেন। যাদের বিভিন্ন গাছ ও তার গুণাগুণ সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছেন ইয়ারব হোসেন।
পার্শ্ববর্তী কলারোয়া উপজেলা থেকে গাছের পাঠশালায় বেড়াতে আসা আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অনেক দিনের আগ্রহ থেকেই গাছের পাঠশালায় এসেছি। এখানে এসে এতো গাছ দেখে মন ভরে গেছে। এখান থেকে আমাকে একটি কদবেল গাছের চারা উপহার দিয়েছে।
ব্যতিক্রমধর্মী এই শিক্ষা কেন্দ্রটি গড়ে তোলা প্রসঙ্গে ইয়ারব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মাঝে মাঝে মনে হতো প্রকৃতি থেকে অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। এছাড়া বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও অধিকাংশ গাছ চেনে না। জানে না এসবের উপকারিতা সম্পর্কেও। তাই বছর খানেক আগে উদ্যোগটি নিয়েছিলাম। এই চিন্তা-চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)। বারসিক প্রথম থেকেই আমাকে কারিগরি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। নামকরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে নামকরণ নিয়ে ভাবিনি। বিলুপ্ত প্রজাতির বৃক্ষ সংগ্রহ করাই ছিল মূল কাজ। পরে চিন্তা করলাম এসব গাছের নাম ও উপকার সম্পর্কে সবার জানা দরকার। তাই নাম দিলাম গাছের পাঠশালা। আর এখন সত্যি সত্যি পাঠশালায় পরিণত হয়েছে এটি। প্রতিদিন এখানে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসছে।
শিক্ষার্থীদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞান দেয়াই গাছের পাঠশালা গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন শ্রেণিতে এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি শিক্ষা, উদ্ভিদবিদ্যাসহ এ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞান চর্চার কোনো ক্ষেত্র থাকে না। তাই গাছের পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞান চর্চার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণাধীন ১২ জন বিসিএস কর্মকর্তা ও বিয়াসের একটি প্রশিক্ষণার্থী দল গাছের পাঠশালা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও তুজলপুর কৃষক ক্লাবের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ইয়ারব হোসেন বলেন, তাদের সার্বিক সহযোগিতাই আমাকে উৎসাহ যোগায়। সম্প্রতি গাছের পাঠশালার উদ্যোগে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে কদবেল গাছের চারা উপহার দেয়া হয়। একই অনুষ্ঠানে গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার শপথ করানো হয় শিশু শিক্ষার্থীদের।
আগামীতে কী পরিকল্পনা রয়েছে? জানতে চাইলে ইয়ারব হোসেন বলেন, আগামীতে গাছের পাঠশালার উদ্যোগে সার্টিফিকেট কোর্স চালুর উদ্যোগ নেয়া হবে। এজন্য কাজ শুরু হয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ইয়ারব মূলত একজন প্রকৃতিপ্রেমী। তার ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখন বৃহৎ স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। যা হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তার এই কার্যক্রমকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। এতে অনেকেই উৎসাহিত হবেন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায়। এগিয়ে আসবেন সমাজের মানুষের কল্যাণে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
এসআই