ভরতখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। টাকা খুইয়ে মলিন মুখে হনহন করে চলে গেলো।
পরপর দু’বার জিতলো। তারপর আবার হারতে হারতে আরও ৪০ টাকা হারলো। তার টাকা খোয়ানো দেখে উদ্বেগ বাড়ছিলো, হয়তো বাড়ি থেকে বাজারের জন্য পাঠিয়েছে। এখন টাকা তো চলে গেলো জুয়াড়ির পকেটে, কি দিয়ে বাজার করবে নয়ন। আর বাজার নিয়ে না ফিরলে তার কি পরিণতি হবে।
নয়নের কাছে প্রশ্ন ছিলো, এতো টাকা সে কই পেয়েছে? ঝটপট জবাব দিলো, মোবাইল কেনার জন্য টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে জমা করেছি।
এখন তো সব গেলো তাহলে কি দিয়ে মোবাইল নেবে। এবার তার উত্তর, এই টাকা গেছে তো কি হয়েছে। বাবাকে বললেই দিয়ে দেবে।
তার বাবা-মা থাকেন ঢাকায়। বাবা মাসুদ মিয়া রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করেন। মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। তাকে দাদাবাড়িতে রেখে গেছে পড়াশুনা করার জন্য। ঢাকায় স্কুলের বেতন অনেক বেশি, প্রাইভেট পড়াতে অনেক টাকা লাগে। তাই দাদার বাড়িতে নয়ন।
বাবা-মা হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কামাই করে টাকা পাঠাচ্ছে। আশা একদিন নয়ন মানুষ হবে। তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু নয়ন কি করছে। এখনই জুয়া খেলায় হাতে খড়ি নিচ্ছে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, কোনোদিন কি লটারিতে লাভ হয়েছে। জবাব দেয়, না খালি গুনেগারি (লোকসান) গেছে।
তবুও খেলার কারণ কি? আজ লাভ হবে মনে করি, তাই খেলাই।
এ খেলায় নয়ন যে অনেক অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তা তার কথাতেও অনুমান করা যায়। জুয়াড়ি মজিবর রহমান যখন ৫ টাকার দুই টিকিটে শুধু সাবান প্রাইজ দিচ্ছিলেন, তখন জুয়াড়িকে বড় খেলা দেওয়ার অনুরোধ করে সে।
আরে শুধু ছোট খেলা দিচ্ছেন। বড় খেলা দেন, দশ টাকা টিকিট লাগান। জুয়াড়ি বলেন, লোক নেই তো। লোক জমুক তখন বড় খেলা হবে।
জুয়াড়ির দোকানে বড় প্রাইজ হচ্ছে প্লাস্টিকের বালতি, সয়াবিন তেল, আড়াইশ’ গ্রামের সরিষার তেল। পাঁচ টাকা দিলে দু’টি করে টিকিট দিচ্ছেন। এরকম প্রায় ৫০টি টিকিট রয়েছে (ভিউ কার্ডের উল্টো দিকে সিরিয়াল নম্বর লেখা) । সব টিকিট বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়।
তারপর কৌটার মধ্যে একই নম্বরের টোকেন তোলা হচ্ছে। যে নম্বর উঠছে তাকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। তবে পুরো ৫০টি টিকেট বিক্রি না হলে অবশিষ্ট টিকিটে পুরস্কার উঠলে সেটা কেউ পাবে না।
শুধু নয়ন নয়, আরও বেশ কয়েকজন ছোট্ট শিশুকে দেখা গেলো সেই লটারি খেলায় যোগ দিতে। তারা অবশ্য পাঁচ-দশ টাকা করে নিয়ে এসে খেলেই চলে যাচ্ছেন মলিন মুখে। হয়তো তার মিঠাই খাওয়ার টাকা, হয়তো মায়ের কোন সওদা কেনার টাকা।
জুয়াড়ির সঙ্গে কথা হয়। তার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার কিশামতবালুয়া গ্রামে। এক ছেলে তিন মেয়ে তার। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটি রাজ মিস্ত্রির যোগালির কাজ করে। বাইশ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। বিভিন্ন হাটে ঘুরে ঘুরে এই লটারি খেলা দেন।
তার কাছে প্রশ্ন ছিলো, আপনার সন্তান যদি এই লটারি খেলে তাহলে আপনি কি খুশি হবেন। কিছু সময় চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, এটা তো ভালো নয়। তাহলে অন্যের ছোট সন্তানকে কেনো এই নেশায় হাতে খড়ি দিচ্ছেন? জবাবে বলেন, আমি আর কোন কাজ শিখিনি তাই বাইশ বছর ধরে এই লটারি চালাচ্ছি। তবে চেষ্টা করবো ভালো হওয়ার।
আয় নাকি মোটামুটি ভালই হয়। তবে হাটকমিটি, পুলিশকে টাকা দিতে হয়, তারপর খুব একটা লাভ থাকে না। এই অঞ্চলের অন্যতম গরু-ছাগলের হাট ভরতখালী। এখানে নিয়মিত বসেন মজিবর লটারি।
শুধু এই হাট বা মজিবর লটারি নন, অনেক মজিবর রয়েছেন। অন্যহাটে অন্য নামে অথবা অন্য কোন ফরম্যাটে চলে এই জুয়া। গ্রামের হাটগুলোতে অলিতে গলিতে এমন লটারি নামের জুয়ার দেখা মিলবে। যারা প্রকাশ্যে এই লটারি চালিয়ে আসছেন। আর তাতে মত্ত হয়ে গ্রামের শিশু কিশোররা জুয়ায় হাতে খড়ি নিচ্ছে। এক সময় নানা রকম অপকর্মে জড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৭
এসআই/জেডএম