আদমজী জুট মিলে তৎকালীন শাসক জিয়াউর রহমানের প্রহসনের ‘হ্যাঁ/না’ ভোটের সময়ে তিনিই একমাত্র “না” ভোট দিয়েছিলেন। এজন্য তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার কারণে বহু অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি ও তার পরিবার এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনীদের নিয়ে বসবাসের অনুপযুক্ত ঘরে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত এখন আব্দুর রহমান।
স্বাধীনতার পরে শশুরবাড়ির আর্থিক সহযোগিতায় ৩ শতক সম্পত্তিতে দুই কক্ষের একটি টিনের বসত ঘর নির্মাণ করেন আব্দুর রহমান। এ ঘরটি এখন ভাঙ্গাচোরা, বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ওপরে তাকালে ঘর থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়। বর্ষাকালে বড় বড় ছিদ্র দিয়ে গড়িয়ে নামে বৃষ্টির পানি আর্থিক অনটনের কারণে ঘরের সংস্কার করতে পারেননি আব্দুর রহমান।
জানা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে থেকেই আদমজী জুট মিলের ৪ নং স্প্রিং ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন এই শেখ আব্দুর রহমান। তার চাকরির টোকেন নং-১৫৮। যুদ্ধ চলাকালে কাজী জহিরুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে মিলের আরও অনেক শ্রমিক ও এলাকার লোকজনের সাথে শরণার্থী হিসেবে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আবারো যোগদান করেন আদমজী
জুট মিলে। ৭৫’র ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পাগলপ্রায় হয়ে যান এই শেখ আব্দুর রহমান। চাকুরীতে থাকাকালীনই এই হত্যার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। সে সময় কোনো শ্রমিক ভয়ে এই বিষয়ে কথা বলতো না। অথচ তিনি এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করতে থাকেন প্রকাশ্যেই। এর ফলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সমর্থক ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার ওপর নেমে আসে অত্যাচার- নির্যাতন।
জিয়াউর রহমানের প্রহসনের ‘হ্যাঁ/না’ ভোটের সময় আদমজী জুট মিলে ৫০ হাজার ভোটের মধ্যে একমাত্র শেখ আব্দুর রহমানই “না” ভোট দেন। এজন্য চাকুরিচ্যুত করা হয় তাকে। এরপর তার জীবনে নেমে আসে অভাব-দারিদ্রের তীব্র কষাঘাত।
আব্দুর রহমানের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, স্বামীর চাকুরিচ্যুতির পর আমার পিতার আর্থিক সহযোগিতায় জীবন অতিবাহিত করেছি। কিছুদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বড় মেয়ের কাপড় বিক্রির আয় দিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শেখ আব্দুর রহমানের বাড়িতে যাওয়ার সরাসরি কোন রাস্তা নেই। অন্যের বাড়ির রাস্তা মাড়িয়ে, কাদা-নর্দমাযুক্ত দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এবং আশেপাশের বিভিন্ন গোয়ালঘর ও ঘরের ময়লা পায়ে ঠেলেই যেতে হয়। বর্তমানে ২ কক্ষের একটি ছোট বাসায় নিজে, স্ত্রী, এক মেয়ে, ছেলে ও তার পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন অত্যন্ত কষ্টে। জায়গা না থাকায় যেখানে থাকা সেখানেই খাওয়া। থাকা ও খাওয়ার ঘরের সাথেই টয়লেট। নেই পয়:নিষ্কাশনের কোনো সু-ব্যবস্থা। একমাত্র ছেলে খোরশেদ আলম অটোরিক্সা চালিয়ে সংসারে কিছুটা সহায়তা করছেন। তার এই স্বল্প আয়ে পরিবার চলছে না। নিজের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও চালাতে পারছেন না।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এই ভালবাসার কারণে এলাকার অনেকের কাছে হাসি-ঠাট্টার খোরাক তিনি মেয়েরা তাকে তাই বাইরে যেতে নিষেধ করেন এক সময়। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও তার বিরোধ-মনোমালিন্য কম নয়। জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নেও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সারাক্ষণই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে
কথা বলে যান আব্দুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু ও আ’লীগ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। আ’লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এই প্রেম দেখে সবাই তাকে ‘শেখ’ নাম উপাধি দেন। সমগ্র চৌদ্দগ্রামে তিনি একজন ‘বঙ্গবন্ধু প্রেমিক’ হিসেবে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি চাঁন্দিশকরায় আব্দুর রহমান নামে তাকে কেউ চিনতে পারে না। কিন্তু শেখ আব্দুর রহমান বলামাত্র গ্রামের যে কেউ দেখিয়ে দেয় তার বাড়ির পথ।
স্ত্রী রোকেয়া কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, বেশ কয়েক বছর পূর্বে ছোট মেয়ের বিয়ে হলেও বাড়ির পরিবেশের কারণে স্বামী তাকে ছেড়ে দেয়। বর্তমানে ছোট মেয়েটিও অভাবের এই সংসারেই রয়েছে। ঝড় বৃষ্টি হলেই আতংকে থাকি। এই বুঝি চাল ভেঙ্গে যাচ্ছে, এই বুঝি টিন উড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে স্বামীর শারীরিক অবস্থাও খুব খারাপ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসার কারণেই আমার স্বামী চাকরি হারিয়ে নিস্ব।
এমন অভাব অনটনের মাঝেও শেখ আব্দুর রহমান এখনো বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই মেতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুই তার কাছে প্রথম এবং শেষ কথা।
বাংলাদেশ সময়:১৩০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
আএজে/জেএম