ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে’

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে’ বানভাসিদের অপলক দৃষ্টি নদীগর্ভে, যেখানে এক টুকরো মাথা গোজার ঠাঁই স্রোতের টানে দুলছে। ছবি: বাংলানিউজ

সাঘাটা, গাইবান্ধা থেকে: নৌকা থেকে নেমেই হাউ-মাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন আব্দুর রশীদ মিয়া। অন্যরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তার কান্না থামছিল না।

কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলছিলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে, সব শেষ হয়ে গেছে’।

পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘তাদের বাড়ি ছিলো জামিরের চরে।

পানি বেড়ে যাওয়ায় ঘরের আসবাবপত্র, গরু-ছাগল নিয়ে ওয়াপদা বাঁধে আসেন। নৌকায় জায়গা না হওয়ায় বেশ কিছু মালামাল ঘরের মধ্যেই রেখে এসেছিলেন’।

‘মালামাল নামিয়ে দিয়ে আবার গিয়েছিলেন বাকিগুলো আনতে। কিন্তু গিয়ে দেখেন, তার ঘর-বাড়িসহ সবই স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। সে শোকেই ম্যুহমান আব্দুর রশীদ মিয়া’।

রশীদের মতোই একশ’র বেশি মানুষের ঘর-বাড়ি পানিতে ভেসে গেছে বলেও জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।  

তারা জানান, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জামিরের চরের ওই পাড়ায় প্রায় ২০০ পরিবার ছিলো, পুরো পাড়াটি তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো ঘরের টিনের চালের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনার পানি। অনেক ঘর দুমড়ে-মুচড়ে ভাসিয়েও নিয়ে গেছে যম মূর্তি ধারণ করা যমুনা।

বাড়ি-ঘর খুলে ও আসবাবপত্র নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন বানভাসিরা।  ছবি: বাংলানিউজসোমবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে সাঘাটা থানার পূর্বদিকে ওয়াপদা বাঁধে গিয়ে দেখা গেছে বানভাসি মানুষের স্রোত। নৌকায় বোঝাই করে সব মালামাল এনে অস্থায়ী বসতি তৈরি করছেন তারা। এখনই জায়গা হচ্ছে না বাঁধটিতে।

জামিরের চরের ঠিক দক্ষিণে এক সময় ছিল চকপাড়া। যমুনাতীরের ওই গ্রামটিতে ছিল বিশাল বসতি। কিন্তু এখন সবই স্মৃতি। বছর সাতেক আগে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু কাগজে-কলমেই রয়েছে চকপাড়ার নাম, বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে এ অঞ্চলে।

এদিকে বন্যার পানি বাড়ছেই। যে কারণে বাঁধে আশ্রয় নিয়েও স্বস্তি পাচ্ছেন না বানভাসি লোকজন।

চরাঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে আছে বন্যার পানিতে।  ছবি: বাংলানিউজঅনেক এলাকায় বন্যায় ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেলে মানুষ শুধু গবাদিপশুগুলোকে শুকনো জায়গায় নিয়ে আসেন। বন্যা কমে গেলে আবার গিয়ে বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু যমুনার চরের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। ঘর রেখে আসাও নিরাপদ নয়। টিনের চালাসহ টিনের বেড়ার ঘরগুলো পুরোপুরি খুলে নিয়ে আসতে হয়।

বন্যা কমে গেলে আবার বাড়ি স্থাপন করে নতুন জীবন শুরু করতে হয় বাসিন্দাদের। কিন্তু ঘরের টিন খুলে আনলেও সেগুলো আর অক্ষত থাকে না।

তবে যাদের বাড়িতে স্রোতের হানা কম লাগবে- তারা ঘর রেখেই চলে এসেছেন। সাঘাটার আকন্দপাড়া খেয়াঘাটে এমন অনেকে তীরে গালে হাত দিয়ে বসে অপলক নয়নে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে বৃদ্ধা সামছুনের অন্য কোনো দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। তার দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করলে এক পলক শুধু চোখে চোখ রাখলেন। কিন্তু কোনো কথাই বললেন না।

অন্যরাও যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। তাদের অপলক দৃষ্টিও নিবদ্ধ নদীর গর্ভে, যেখানে এক টুকরো মাথা গোজার ঠাঁই স্রোতের টানে দুলছে। আবার কেউ কেউ শূন্যভিটার দিকে চেয়ে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন।

পুরো এলাকায় বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে, কারো মুখেই হাসি নেই। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও খেলতে ভুলে গেছে। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭  
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।