ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘মোগো ইলিশ, ধইর‌্যা লইয়া যায় ভারতের জাইল্যারা’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
‘মোগো ইলিশ, ধইর‌্যা লইয়া যায় ভারতের জাইল্যারা’ ‘মোগো ইলিশ, ধইর‌্যা লইয়া যায় ভারতের জাইল্যারা, ছবি: বাংলানিউজ

বিএফডিসি মৎস্য অবতরণকেন্দ্র ঘুরে: ‘লাভ ক্ষতি বুঝি না, সাগরের ইলিশ মোগো, কিন্তু ধইর‌্যা লইয়া যায় ভারতের জাইল্যরা। মোরা শুধু চাইয়া চাইয়া দেহি। করার কিছুই নাই’

সাগর থেকে ফিরে এ প্রতিবেদকের সাথে এভাবেই রাজ্যের হতাশা আর ক্ষোভ উগড়ে দিলেন বরগুনার পাথরঘাটার ট্রলারের মাঝি মো.আলতাফ মিয়া।

ইলিশ এখন বাংলাদেশের নিজস্ব প্যাটেন্ট পণ্য হয়েছে একথা তাকে জানানোর পর তার প্রতিক্রিয়াটি ছিল দেখার মতো।

আলতাফ মাঝি বললেন, জীবন ভইরা সাগরের ইলিশরে মোরা মোগোই ভাবছি। কিন্তু ভারত আর বার্মার জাইল্যারা হাজার হাজার ট্রলার দিয়া মাছ ধইর‌্যা লইয়া যায়। ‘মোগো ইলিশ, ধইর‌্যা লইয়া যায় ভারতের জাইল্যারা, ছবি: বাংলানিউজ

শুধু আলতাফ মাঝিই নয়, একাধিক জেলের সাথে কথা বলেও জানা যায় বাংলাদেশের জল-সীমানায় ঢুকে বিদেশি জেলেদের মাছ শিকারের কথা।

অভাব আর দু:খ-দৈন্য কখনোই এই জেলেদের, ট্রলার-শ্রমিক এই মাঝি-মাল্লাদের পিছু ছাড়ে না। প্রতিকূলতা তাদের চেপে ধরে প্রতিনিয়ত। পেটের দায়ে হাজারো প্রতিকূলতার মাঝেও তারা মাছ ধরতে যায় দূর সমুদ্রে। দেশ যখন বাংলাদেশের ইলিশ বলে উৎসব করছে তখন জেলেরা বলেছে, বিদেশি ট্রলারের দৌরাত্ম্য দেখে মনে হয় ইলিশ বাংলাদেশের যেন নয়, এই ইলিশ যেন ভারত আর মায়ানমারের।

হাজারো ক্ষোভ আর হতাশা নিয়েই এমন খেদোক্তি করে নিজেদের ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেন মৎস্যজীবী জেলেরা। সদ্যঘোষিত জিআইর খবরটি এখনো পৌঁছায়নি প্রান্তিক জেলেদের কাছ বরাবর। এখনো জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) কি বা কেন এই ব্যাপারে জানার তেমন কোনো আগ্রহ নেই তাদের। কেউ কেউ বলছেন, এসব রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে আগ্রহ নেই তাদের। তারা মাছ ধরে সংসার টিকিয়ে রাখতে পারলেই হয়।

কথা হয় জাকির হোসেন মাঝির সঙ্গে। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় জেলেরা দেশীয় জেলেদের তাড়িয়ে দিয়ে মাছ শিকার করছে। শুধু ইলিশ মৌসুমেই নয়, পুরো বছরই চলে ভারতীয় জেলেদের জোর জবরদস্তিমূলক মাস্তানি-গুন্ডামি।

ভারত আর মায়ানমারের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াইয়ে সমুদ্রজয়ের পরেও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা। অনুপ্রবেশ করে এরা দেশীয় জেলেদের মাছ শিকারে বাধা দিচ্ছে। এদের প্রতিরোধে যেমন নেই কোনো জোরালো পদক্ষেপ, তেমনি বাংলাদেশি জেলেদের নিরাপত্তায়ও নেই কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা। ইলিশের জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) বা ভৌগলিক নির্দেশকের খুশির খবরটি জেলেদের মাঝে এখনো পৌঁছায়নি। ‘মোগো ইলিশ, ধইর‌্যা লইয়া যায় ভারতের জাইল্যারা, ছবি: বাংলানিউজ
পাথরঘাটার উপকূলীয় জেলেরা সব সময়ই ভারত আর মায়ানমারের জেলেদের আতঙ্কে ভোগেন। একাধিক মাঝিমাল্লা ও জেলেরা জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন, মহিপুর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পাথরঘাটা থেকে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের জেলেরা বঙ্গোপসাগরের ৪০ থেকে ৫০ বাম এলাকায় জাল পেতে মাছ শিকার করে থাকেন। কিন্তু ভারতীয় জেলেরা নৌ-সীমানা লংঘন করে বাংলাদেশি জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যায়।

সাগরে অধিকাংশ সময়ই ভারতীয় জেলেদের উৎপাত চলে উল্লেখ করে জেলেদের একটি সূত্র জানায়, তারা ছোট ফাঁসের কারেন্ট জালসহ ৫ থেকে ৬ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে থাকে। পাশাপাশি মাছের পোনাও ধরে। এক সাথে ৩০ থেকে ৪০টি ট্রলার অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার করে। তাদের কাছে থাকে জিপিএস(বিশেষ সংকেত) নামক বিশেষ ধরণের যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় জেলেরা যে পথ দিয়ে সাগরে আসে, পূনরায় সে পথ দিয়েই খুব সহজে ফিরে যায়। অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে সাগরের তলদেশের মাছ দেখে জাল ফেলে তারা। এছাড়া তারা মোবাইল ফোন, অত্যাধুনিক ওয়্যারলেস সেটসহ বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করে। এতে করে তাদের কোনো ট্রলার সাগরে বাধার মুখে পড়লে বা আক্রান্ত হলে দ্রুত অন্যদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। ফলে তারা খুব সহজেই বাংলাদেশ সীমানা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বের কাছে ইলিশের মাধ্যমে আবারও উচ্চ মর্যাদা পেল বাংলাদেশ। আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মায়ানমার ও ভারতের জেলেদের অবৈধভাবে মাছ শিকার বন্ধের ব্যাপারে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন এটাই আশা করছি।

৭ আগস্ট জামদানির পর বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর ফলে ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পাবে। প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন পণ্য হিসেবে ইলিশ নিবন্ধনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মত্স্য অধিদফতরের হাতে ইলিশের জিআই নিবন্ধনের সনদ তুলে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।