ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড!

শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৭
ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড! ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড!

ঢাকা: ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৫ সালের এই কলঙ্কিত দিনে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ঘাতকচক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। নারী ও শিশুদেরও রেহাই দেয়নি মানুষ নামের পিশাচ ঘাতকেরা।

হাজার বছরের নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়। পর্বতসম সাহস আর সাগরের মতো হৃদয়ের অধিকারী শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে বাঙালিকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক অপ-শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন তার অতুল্য নেতৃত্বে।

তার উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে, ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য’ করে গোটা বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বৃটিশ শাসনের অবসান হলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে সেদিন মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারেনি এদেশের মানুষ। বরং পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই  বাঙালির উপর চলতে থাকে আধিপত্যকামী পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও নানাবিধ বঞ্চনা।

অবশেষে বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত করেন শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ভূষিত হন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। এই আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। বার বার তাকে হতে হয় মৃত্যুর মুখোমুখি। কিন্তু দমে যাননি এই ‘বঙ্গ শার্দুল’। সামরিক রক্তচক্ষুর কাছে তিনি কখনো নোয়াননি তার উঁচু মাথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এদেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় এক উজ্জীবিত স্বাধীন, নবীন রাষ্ট্র। নামটি যার বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে বিশ্বে একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয় ঘটে।  
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি অধিষ্ঠিত করে তাদের ‘জাতির পিতা’র আসনে। বিশ্ববাসীর কাছেও বঙ্গবন্ধু পরিচিত হয়ে উঠেন নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসেবে। সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন বিশাল হৃদয়ের অকৃত্রিম বন্ধুকে।  

এর আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফিদেল বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা ও নির্ভীকতায় এই ব্যক্তি হিমালয়সম। ’ 

স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অনেক বাধা ডিঙিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ঠাণ্ডা মাথায় তাকে সপরিবারে খুন করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি দল হানা দেয়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকলকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।  

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মুলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ভুলুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে পদদলিত করে উল্টো পথে সেই পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে ধাবিত হয় বাংলাদেশ। আবারও বাঙালির ঘাড়ে জেঁকে বসে সামরিক স্বৈরশাসন।

স্বাধীনতার পর জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে হত্যার পর তার গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে একে একে বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্র, পাল্টা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালাবদল হতে থাকে। সেই সঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে থাকে।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনের কাজে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, নিরলস। তার অতুলনীয় গণমুখী নেতুত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯-এর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৭০-এর নির্বাচনে বিজযের পর ১৯৭১-এ এসে উপনীত হয়। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৭১-এর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরোক্ষ দিকনির্দেশনা দিতে বাধ্য হন।  

বঙ্গবন্ধু ওই দিন তার ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রম। বঙ্গবন্ধুর এই ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় বাঙালি। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
 
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য ছিল প্রেরণাদায়ক।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে ৪ বছরের মাথায় তাঁকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবেই আজ বঙ্গবন্ধু তাদের হূদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। প্রতিবছর এই দিনটিতে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর শোকে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে। দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে প্রতিবছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে। এবছর বঙ্গবন্ধুর ৪২তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ও শোকের কালো পতাকা শোভা পাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয়। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে এবং ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে দিনভর।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
এসকে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad