ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ধর্ষণের ৮৫ ভাগ ঘটনাই প্রণয়ঘটিত: ঢাকার এসপি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
ধর্ষণের ৮৫ ভাগ ঘটনাই প্রণয়ঘটিত: ঢাকার এসপি ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ফাইল ফটো

ঢাকা: ধর্ষণ নিয়ে যতো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় তার চেয়ে রাজনীতিটাই হয় বেশি। এ ধরনের স্পর্শকাতর মামলা নিয়ে আমাদের তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ বলছে, ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগই সংঘটিত হচ্ছে কথিত ভিকটিম ও আসামির মধ্যে প্রণয়জনিত কারণে, পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে।

সামাজিক ও আদিম অপরাধ ধর্ষণ নিয়ে এভাবেই পুলিশের পর্যবেক্ষণের কথা জানান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান।

তার মতে, ধর্ষণের মতো অপরাধ ছাড়াও বাংলাদেশে প্রতি ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এত বেশী রাজনীতি হয়, যে কারণে প্রকৃত ঘটনা আর নেপথ্যের সমস্যাগুলোই আড়ালে পড়ে যায়।

প্রকৃতপক্ষেই ধর্ষণ অপরাধের আইনি সজ্ঞা অনুযায়ী যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মামলা হয় তার প্রায় ৯৫ ভাগ মামলার বিচারে নিশ্চিত সাজা হচ্ছে- এমনটিই অভিমত তার।

পুলিশের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ২০০১ সালে পুলিশে যোগদান করে দিনাজপুর জেলা, সিএমপি, র্যাব, এসবি ও যশোর জেলায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে দু'বার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পাওয়া ‘জাতিসংঘ শান্তি পদক’।

পুলিশ সুপার হিসেবে লক্ষ্মীপুর জেলায় সন্ত্রাস ও গডফাদার দমনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার স্বাক্ষর রাখা শাহ মিজান শাফিউর রহমান সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগে উপ পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব পালন শেষে এখন ঢাকার এসপি।

ধর্ষণ নিয়ে তিনি যখন এমন অভিমত দিচ্ছেন তখন ধর্ষণজনিত অপরাধ নিয়ে সরগরম খোদ ঢাকা জেলাই। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে ঢাকার আশুলিয়ায় এক বাউল শিল্পীকে ‘গানের অনুষ্ঠানে নিয়ে’ আউকপাড়া শহিদুল্লাহর খামার বাড়িতে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। ওই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।

চলতি মাসের শুরুতে আশুলিয়াতেই অন্বেষা ফ্যাশন নামের তৈরি পোশাক কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থাপক হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে একাধিক নারী পোশাক শ্রমিককে নিজ অফিসে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সাতটি শ্রমিক সংগঠন জোট বেঁধে তাকে গ্রেফতারের জন্য মানববন্ধন করে।

এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার এক নারী শ্রমিক মামলা দায়ের করলে গত শনিবার নোয়াখালী জেলার কবিরহাট থানার মালিপাড়া গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হারুন অর রশিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান।  ফাইল ফটো

তাহলে কি ধর্ষণের মতো অপরাধ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে? এর পেছনের কারণ কি? অপরাধ দমনে পুলিশের দায় কতোটুকু?

জবাবে পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, ধর্ষণের ঘটনা যে ঘটছে না তা কিন্তু নয়। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। আবার দ্রুত গতিতে আসামিও ধরা পড়ছে।

তবে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত ঘটনাগুলোকে সেভাবে বিশ্লেষণ না করে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যাতে মনে হয় পুলিশ বাহিনী হাত গুটিয়ে বসে আছে।

গণমাধ্যম বা টিভির টকশো বিশ্লেষণ করে অনেকের ধারণা হতে পারে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পুলিশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই বুঝি এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তারওপর বিরোধী পক্ষ থেকেও আরো উত্তাপ ছড়ানো হয় রাজনীতির মাঠে। এতে গরম হয় মাঠ। এর ফলে সমাজের কি ক্ষতি হচ্ছে তা কি আমরা অনুধাবন করছি?

আমাদের ভাবনায় আনতে হবে, আকাশ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির বিকাশের কথা।   সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক ব্যবহারে সমাজে আমরা অপরাধ ছড়াচ্ছি।

আজ পারিবারিকভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কর্মকাণ্ডগুলো যথাযথভাবে পারিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য বা অভিভাবকরাও নজরে রাখছেন না। সমাজে নীতি নৈতিকতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। প্রেম বা ভালোবাসার পবিত্রতম যে ভাব তা নষ্ট হয়ে শারীরিক সম্পর্ক প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে সমাজ ব্যবস্থার আড়ালে, আবডালে বা পর্দার অন্তরালে তরুণ-তরুণীরা প্রেম বা ভালোবাসার নামে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। সেগুলো আবার গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাড়ছে অবিশ্বাস, অস্থিরতা ও সম্পর্কের টানাপড়েন। গণমাধ্যম আর সমাজ হচ্ছে বিচলিত। সরকার ও পুলিশি ব্যবস্থা  হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনায় যেভাবে শোরগোল তোলা হচ্ছে সেভাবেই চাপা পড়ে যাচ্ছে ঘটনার আড়ালের ঘটনা।

ধরুন, প্রণয়জনিত কারণে দুজনার সম্মতিতে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন হলো। তখন কিন্তু সেটা ছিলো তাদের প্রণয়ের একটি অধ্যায়। পরবর্তীতে নানা স্বার্থ আর দ্বন্দ্বে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তখন তা ‘ধর্ষণ ’ উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিম কিংবা বাদী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ২২ ধারায় জবানবন্দিতে ধর্ষণ হিসাবে বিষয়টি অখ্যায়িত করলে এসব মামলার অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। তবে পরবর্তীতে বিচার কালীন সময়ে উভয়পক্ষের মধ্যে আপোস-মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে বলে বিচারে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। তখনো বিচারহীনতার সংস্কৃতি- এমন নানান কথা বলে হৈচৈ তোলা হয়।

তবে আড়ালেই চাপা পড়ে উভয়পক্ষের সমঝোতার বিষয়টি। দায় চাপানো হয় তদন্তকারী সংস্থার ওপর।  

তাই সময় এসেছে, আমাদের সবাইকে সচেতন হবার। সম্মিলিতভাবে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে আমাদের। সব ঘটনা প্রকৃত ধর্ষণের ঘটনা কিনা তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে সবাইকেই।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, আগস্ট  ১৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।