কিন্তু এই ভেজাটা যখন ‘ডুব সাঁতারে’ রূপ নেয়, তখন কী আর মেনে নেওয়া যায়? হাঁটু ছুঁতে ছুঁতে পানি যখন কোমর অব্দি ওঠে, তখন সেটা আর দুর্ভোগ থাকে না, রূপ নেয় রীতিমতো দুযোর্গে!
বুধবার (২৬ জুলাই) প্রায় সারা দিন এমন দুযোর্গই পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। বুড়িগঙ্গা থেকে তুরাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ঢাকার প্রায় সব সড়ক, লেন, অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট ‘হঠাৎ সাগরে’ রূপ নেয় এদিন।
ঢাকার বেশিরভাগ সড়ক খানা-খন্দে ভরা। কিন্তু কুড়িল বিশ্বরোড থেকে প্রগতি সরণি হয়ে বাড্ডা-রামপুরা-মৌচাক-কাকরাইল সড়ক দুর্ভোগের দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে। বৃষ্টি-বাদল ছাড়া স্বাভাবিক দিনগুলোতেও পারতপক্ষে এ সড়ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন সবাই।
আর টানা বর্ষণে এই সড়কের দুর্ভোগ কোন পযায়ে পৌঁছায়, তা রীতিমতো টের পেয়েছে বুধবার (২৬ জুলাই) যারা এ সড়ক মাড়িয়েছেন। তার-ই একটি চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে।
সকাল সাড়ে ৮ টায় বাড্ডা লিংকরোড থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের উদ্দেশে বাসযোগে যাত্রা শুরু। সাড়ে ৯টা নাগাদ টানা ১ ঘণ্টা প্রাণপন চেষ্টায় বাসটি পৌঁছাতে পেরেছিল রামপুরা কাঁচাবাজার পর্যন্ত।
খানা-খন্দে ভরা রাস্তায় এরপর আর এগোতে পারে নি বাসটি। পেছনের দু’টি চাকাই পাংচার। সব যাত্রীকে নামতে হলো রাস্তায়। অপেক্ষা এবার বিকল্প বাহনের।
কিন্তু সামনে যে অথৈ সাগর! মালিবাগ চৌধুরী পাড়া থেকে রেলক্রসিং, শান্তিনগর, কাকরাইল মোড়, সেগুনবাগিচা, তোপখানা রোড পযর্ন্ত যেতে অন্তত আট/দশটি ‘সড়কসাগর’ পাড়ি দিতে হবে।
সঙ্গত কারণেই কোনো রিকশাওয়ালাকে রাজি করানো যাচ্ছিল না। বাসগুলো গেটলক। সিএনজির কথা মাথায় আনারও জো নেই। ‘পকেটকাটা’ এ বাহনটি এ পথে ভুল করেও আসে না।
পরম সৌভাগ্য হয়ে এলো এক কিশোর রিকশা চালক। দ্বীপ জেলা ভোলা থেকে সদ্য ঢাকায় আসা এ কিশোরের কাছে সড়কে জমে থাকা কোমর সমান পানি যেন ঘড়ায় তোলা জল! কিছুতেই সে বাঁধ মানে না।
কিন্তু ড্রেন ও স্যুয়ারেজ লাইন উপচে পড়া নোংরা পানিতে চুবানি খাওয়ার ভয়ে তাকে বার বার সংযোগ সড়কে বিকল্প পথ ধরার অনুরোধ করা হচ্ছিল। সে চেষ্টাও করছিল বার বার। কিন্তু যেদিকেই যাই কোমর সমান পানি।
মূল সড়ক থেকে যতটা গলির ভেতর যাওয়া যায়, পানির গভীরতা ততোটাই বেশি। সুতরাং সামনে না এগিয়ে ফের পেছন ফিরে আসতে হলো কয়েকবার।
এভাবে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে কোমর পানি সাঁতরে মৌচাক পৌঁছাতে সময় লাগল আরো প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার রিকশা উল্টে যাওয়ার উপক্রম হলো।
মাথার উপর ভারী বর্ষণ। পায়ের নিচে কোমর সমান পানি। সড়কে তীব্র যানজট। দমকা হাওয়ায় রিকশামোড়ানো পলিথিন, শরীর বাঁচাতে তাক করে রাখা ছাতা উড়ে যেতে চায়- এ দুর্ভোগে শেষ কোথায়?
এভাবেই টানা পৌনে ২ ঘণ্টা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় ডিআরইউ পৌঁছালো ভোলার সাহসী কিশোর ফিরোজের রিকশা। কিন্তু সেখানেও হাঁটু পানি। দ্রুত গতিতে ছুটে চলা প্রাইভেট কার এসে বাকিটুকুও ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
শুধু জীবন আর জীবিকার সন্ধানে বের হওয়া মানুষ নয়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গণপরিবহনের কর্মী, ভ্যান-রিকশা-সিএনজি চালক- সবারই হয়েছে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা। এর জন্য দায়ি কী শুধুই প্রকৃতি?
মৌসুমি বৃষ্টি তো শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে নামে না। এই গ্রহের অন্যান্য শহরেও নামে। সেখানেও কি এ রকম হয়। সড়ক বেয়ে নৌকা চলে? কে দেবে উত্তর?
প্রায় অর্ধযুগ ধরে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণাধীন রয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এ পথ যেন স্রোতস্বিনী নদী! টানা চার দিনের বর্ষণে সেটা এখন সাগর! পৃথিবীর আর কোনো শহরে এমন ফ্লাইওভার আছে কি?-যেটা নির্মাণে ছয় মাসের জায়গায় লেগেছে ছয় বছর?
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৭
এজেড/আরআই