এভাবেই গ্রামের পর গ্রাম আলোয় আলোকিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে প্রত্যন্ত গ্রামের ‘শ্রমকল্যাণ পাবলিক পাঠাগার’।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পূর্ব দলিরাম বড়বাড়ি গ্রামে মাত্র ১৩ জন কৃষিশ্রমিকের হাড়ভাঙা কায়িক পরিশ্রমের চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠা পাঠাগারটির সদস্য ও পাঠক সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
নীলফামারী জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে পাগলাপীর-জলঢাকা সড়কের গোড়গ্রাম বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রামীণ সড়কে সামান্য এগোলেই শ্রমকল্যাণ পাবলিক পাঠাগার।
সরেজমিনে জানা গেছে, এলাকা ও সমাজের উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখার মনোবাসনায় একদল কৃষিশ্রমিক প্রথম পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় জায়গা আর অর্থ। ছাত্র ও পরিবারের ওপর নির্ভরশীল এসব শ্রমিক মনোবল শক্ত করে পুরোদমে কৃষিকাজ শুরু করেন। ধান কাটা-মাড়াই, ক্ষেতের নিড়ানিসহ সব ধরনের কৃষিকাজ করে অর্থ সংগ্রহ করেন। তারপর ৩০ কিলোমিটার দূরের রংপুর শহর থেকে কিনে আনেন কিছু জ্ঞানভিত্তিক বই।
এলাকার সমাজ সচেতন মানুষ আনিছুর রহমান পাঠাগারের জন্য ৮ শতক জমি দেন। এলাকাবাসী ও মুক্তা আপার সহযোগিতায় বাঁশ দিয়ে নির্মিত হয় বই রাখার র্যাক। অবশেষে সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জ্ঞানের অলোয় আলোকিত সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে ২০১০ সালের ১৮ জুন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক ফজলুল হকের হাতে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে পাঠাগারটি। শ্রমের বিনিময়ে সমাজের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটির নাম রাখা হয় ‘শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগার’।
পাঠাগারে এ পর্যন্ত সংগৃহীত হয়েছে হাজার খানেক বই। নিয়মিত সদস্য সংখ্যা ৩ শতাধিক। টিনসেড ঘরের পাঠাগারে নিয়মিত বই পড়তে আসেন সদস্য ও পাঠকরা।
সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় পাঠাগারের সদস্যরা আলাপ-আলোচনা করে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে নিজেরাই সেগুলো বাস্তবায়ন করেন।
পাঠাগারটিতে কারিগরি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে আরডিআরএস। সেভ দ্য চিলড্রেনের অর্থায়নে এ কেন্দ্রের শিশুদের হাতে এসেছে ট্যাবও। তারা এ ট্যাবে পড়াশোনা করছে, নাচের তালে তালে পড়ছে ছড়াও।
‘আমরাই পারি, আমরা পারবো, আলোকিত সমাজ গড়বো’- প্রতিপাদ্যে পাঠাগারের সদস্যদের মাসিক ১০ টাকা হারে সঞ্চিত অর্থে কার্যক্রম চালিয়ে এভাবেই পুরো ইউনিয়নকেই আলোকিত করে চলেছে শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগার।
পাঠাগারের সভাপতি আর এম তৌফিকুল ইসলাম মিশুক বলেন, ‘১৩ জন কৃষিশ্রমিকের কষ্টার্জিত চাঁদার ১৩ হাজার টাকায় পাঠাগারের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে সকলের সহযোগিতায় এ পর্যন্ত এসেছে পাঠাগারটি। তবে বই সঙ্কট ছাড়াও রিডিং টেবিল ও র্যাকসহ নানা অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে’।
‘সকলের মতামতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাঠাগারের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এলাকাকে বাল্যবিবাহ, মাদক ও অপরাধমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে’।
দেরিতে হলেও মানুষ বুঝতে পেরেছেন- এটিই পাঠাগারটির সাফল্য বলেও মনে করেন মিশুক।
শ্রম কল্যাণ পাঠাগারের অর্থ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামিয়ার রহমান লায়ন জানান, পাঠাগারটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় ৬টি উপ-কমিটি করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- অর্থ, শিল্পকলা, তথ্য ও যোগাযোগ, সমাজসেবা, ক্রীড়া ও নারী এবং শিশু অধিদফতর। এছাড়া যুবকদের নিয়ে পাঠাগারের বাইরে সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও সচেতনতা বাড়াতে গড়া হয়েছে যুব ফোরাম। ইতোমধ্যে প্রত্যন্ত গ্রামের পাঠাগারটির খবর পৌঁছে গেছে বহির্বিশ্বেও। আমেরিকা, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা শ্রম কল্যাণ পাঠাগারটি ঘুরে দেখে গেছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলও পরিদর্শন করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৭
এএসআর