কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের পৃথিমপাশা গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের মেয়ে পপি বেগমের বিয়ে হয়েছিল আব্দুল হকের সাথে। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এলাকার ছোটদেশ নামের এক গ্রামে।
পঞ্চম শ্রেণীতে ঠিকমতো লেখাপড়া না করেই সেন্টার পরীক্ষা দেয়। তাতে কোনো রকমে পাশ করে আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় সে। পরে জেএসসি পরীক্ষায় ‘এ’ পেয়ে পাশ করে। তার মা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রান্নাবান্নার কাজ করে করে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে থাকেন। একপর্যায়ে ‘পাতাকুড়ি’ নামের একটি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির স্থানীয় কার্যালয়ে ১৫ শত টাকা বেতনে কাজ করতে থাকেন মা পপি বেগম। সে টাকা দিয়েই ছেলের লেখা-পড়ার খরচসহ পরিবারের খরচ চালাতে থাকেন। ছেলে হামিম মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে থাকে। পড়ালেখার পাশাপাশি সে টিউশনি করে মায়ের পরিবারে কিছুটা অর্থের যোগান দিতো ও নিজের পকেট খরচ চালাতো।
সরেজমিন, পৃথিমপাশা গ্রামে হামিমের নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,তার মা কাজের জন্য পাতাকুড়িতে গেছেন। সে চলে গেছে সিলেটে কোচিং করতে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় ছোট একটি ঘরে মা ছেলে থাকেন। চুলার একেবারে কাছেই রয়েছে তার পড়ার টেবিল। সেখানে বসেই সে লেখাপড়া করতো। মা সাংবাদিক এসেছে খবর পেয়েই রান্নার কাজ ফেলে ছুটে আসেন বাড়িতে। এসেই আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি টেবিলে বসে ছেলের বই-খাতাগুলো একটি ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াচ্ছি। ছেলেটি আমার সন্মান রেখেছে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে। ’
পপি বেগম বাংলানিউজকে বলেন, হামিমের বাবা এর আগে একটি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেই স্ত্রী মারা গেলে তাকে (পপি বেগমকে) বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরের একটি ছেলেসন্তান ছিল। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সাথে তার ঝগড়া লেগেই থাকতো। ছেলে যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়তো তখনই বাবার বাড়িতে চলে আসেন। তিনি আসার পর স্বামী আরেকটি বিয়ে করলে সেখানে আর যাননি। বাবার বাড়িতেই থেকে যান। এখানেই ছেলেকে লেখাপড়া করাতে থাকেন।
পপি বেগম জানান, বাবা মারা যাবার পর খুব সমস্যায় পড়েন। তখন থেকে মানুষের বাড়ি বাড়ি এবং পরে একটি এনজিও সংস্থায় রান্নার কাজ নেন।
তিনি বলেন, ছেলের লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনে তিনি তার বাবার বাড়িতে পাওয়া ২শতাংশ জায়গা বিক্রি করে দেবেন।
সিলেট কোচিং এ থাকা জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হামিম আহমদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে সে বাংলানিউজকে সে জানায়, তার মায়ের জন্যই সে এতদূর আসতে পেরেছে।
হামিম জানায়, জেএসসি পাশ করার পর তার বাবা তাকে একটুখানি একটু সাহায্য করেছেন। এখন তিনি খুব বেশি বেশি খোঁজ নিচ্ছেন।
কথা প্রসঙ্গে হামিম আরও জানায়, তার ইচ্ছা লেখাপড়া করে বিসিএস দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করা। বর্তমানে ইউসিসি’তে তিন মাসের জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোচিং করছে। উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া। সে তার মায়ের কষ্টার্জিত টাকার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করতে সব সময় প্রস্তুত। সমাজের বিত্তবানরা যদি তার দিকে সহায়তার হাত বাড়ান তবে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে সে।
প্রসঙ্গত, এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ ছিল ৪.৫৬।
তার এমন রেজাল্টের পিছনে তার মা ছাড়াও তার শিক্ষকদেরও অনেক অবদান রয়েছে। তার ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করা। কিন্ত টাকার অভাবের কারণে সেটা সে পারেনি।
এব্যাপারে আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের। তার পারিবারিক দৈন্য দশার কথা সবারই জানা ছিল। সে খুবই মেধাবী।
অধ্যক্ষ আব্দুল কাদির চান উচ্চশিক্ষা লাভ করে সে যেন সমাজের ও দেশের মানুষের কাজে লাগে।
এব্যাপারে আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সভাপতি নবাব আলী নকি খান বলেন, স্কুলটি কলেজের স্বীকৃতি পাবার পর থেকে কলেজের শিক্ষকরা কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও তাদের মতো করে লেখা-পড়া করতে থাকে। তাই কুলাউড়া উপজেলায় শুধু তাদের কলেজেই দু’টি জিপিএ-৫ এসেছে। হামিম অত্যন্ত ভাল ছেলে তার আর্থিক অবস্থা খারাপ দেখে তার বেতন মওকুফ করে দেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়:১৪৫২ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৭
এম এ এইচ/ জেএম