ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরির প্রমাণ মিললেও স্বপদে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৭
জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরির প্রমাণ মিললেও স্বপদে

পাবনা: জেলা শিক্ষা অফিসারের তদন্তে প্রমাণ মিললেও এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেয়া পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তায়জুল ইসলাম।

বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদের স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেননি তায়জুল। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিতে যোগদানের দশবছরেও তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সালে চাটমোহর উপজেলার অষ্টমনিষা মির্জাপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের ছেলে তায়জুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা সন্তান পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির আবেদন করেন। ২০০৬ সালে ৩২ বছর বয়সে চাকরিতে যোগদান করে বর্তমানে পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত রয়েছেন।

এদিকে, ভুল তথ্য দিয়ে অমুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেয়ায় পাবনা শহরের গোবিন্দা এলাকার আব্দুল হাইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে আইনজীবী রফিকুল আলম দিপু ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর তায়জুল ইসলামকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান।

নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তালিকায় তায়জুলের বাবা আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের নাম উল্লেখ নেই। তিনি ভুল তথ্য দিয়ে সরকারি চাকরি গ্রহণ করায় ওই পদে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরি বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চাটমোহর উপজেলা কমান্ড কাউন্সিল সূত্রে জানা যায়, সংক্ষুব্ধ মহলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মহাসচিব (প্রশাসন) আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিশ্চিত হবার জন্য চিঠি দেন। ২০১১ সালের তালিকায় নাম না থাকায় আব্দুল আজিজ সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে সংযুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে সব শর্তাবলী সাপেক্ষে মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা হবে সেগুলো হচ্ছে: যারা ভারতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যাদের নাম ভারতীয় তালিকায় আছে, লালমুক্তিবার্তায় যাদের নাম আছে, যাদের প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত সনদ আছে, যে সব পেশাজীবী বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রেখেছেন, মুজিবনগর সরকারে যারা কাজ করেছেন, সশস্ত্রবাহিনী, আনসার, পুলিশ, ইপিআর (বিজিবি) সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ, এমপিএগণ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত নারীগণ (বীরাঙ্গনা), স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীবৃন্দ, দেশের বাইরে দায়িত্বপালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবাদানকারী সেবাকর্মী। উপরোক্ত শর্তাবলীর কোনটিই আব্দুল আজিজ প্রামাণিক পূরণ করতে পারেন নি।

এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চাটমোহর উপজেলা ইউনিটের কমান্ডার মোজাহার হোসেন বলেন, আব্দুল আজিজ প্রামাণিক কোথায় যুদ্ধ করেছেন আমাদের তা জানা নেই। তাকে আমাদের চাটমোহরের মুক্তিযোদ্ধারা শনাক্ত করতে পারেন নি। আমরা তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের বাবুর্চী ছিলেন। তবে, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অনেকের সঙ্গে কথা বলেও তাদের কোনো বাবুর্চী ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর, মুক্তিযুদ্ধ কোনো আনন্দ ভ্রমণ ছিল না যে, মুক্তিযোদ্ধারা বাবুর্চী নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন।

উপজেলা কমান্ডার আরো বলেন, যেহেতু ২০১১ সালের তালিকায় আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম নেই। সুতরাং, তার সন্তানদের ২০০৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির আবেদনের কোনো সুযোগ নেই।

যাচাই বাছাই কমিটিতে জোরালো প্রতিবাদ করার পরও প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে আব্দুল আজিজকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভূয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তায়জুলের চাকরির বিষয়টি তদন্তে জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্ত শেষে গত ৪ জুলাই পাবনা জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

তদন্ত প্রসঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন জানান, বেশ কয়েকবার সময় দেবার পরও পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তায়জুল ইসলাম তার বাবা আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের মুক্তিযোদ্ধা সনদের স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

তাড়াশ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্র জমা দিলেও, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল প্রদত্ত সঙ্গার শর্তাবলী পূরণ হয়নি। মুক্তিবার্তা তালিকা, ভারতীয় তালিকা কিংবা প্রধানমন্ত্রী প্রতি স্বাক্ষরিত সনদ এর কোনটিই তার নেই। কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বরাবর বার বার চিঠি দিয়েও উত্তর পাওয়া যায় নি।

তবে, মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর হার্ডকপির প্রয়োজন হবে না বলে গত ২০ জুলাই পরিপত্র জারী করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সম্মানী ভাতা, চাকরিতে নিয়োগ অথবা মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে রক্ষিত তালিকা যাচাই বাছাই পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পরিপত্র অনুযায়ী, ওয়েব সাইটের সর্বশেষ হালনাগাদকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়ও তায়জুলের বাবার নাম না থাকায়, তার সরকারি চাকরিতে বহাল থাকার কোন অধিকার নেই।

সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেয়া এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তিনি তার কর্মস্থলে নিজ পদে বহাল রয়েছেন। তার অপকর্মের বিষয়ে কেউ মুখ খুললে ভাড়াটে মাস্তান পাঠিয়ে তাদের হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক।

চাটমোহর মির্জাপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও পাবনা বার সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আব্দুল আজিজ প্রামাণিক মুক্তিযোদ্ধা নন। জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে তিনি ও তার সন্তানেরা সব মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করেছেন। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান সরকার নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য আজ মুক্তিযোদ্ধা শব্দের আগে ভুয়া যোগ হচ্ছে, এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির বিষয়ে সরকারকে আরো কঠোর হবার আহবান জানান।

এসব বিষয়ে পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওয়াজেদ আলী জানান, সহকারী শিক্ষক তায়জুলের ব্যাপারে এখনো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত আসেনি। এ বিষয়ে বিভাগীয় পত্র পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, ২৪ জুলাই, ২০১৭
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।