ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

এই বিমানবন্দর অনেক আবেগের... 

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০২ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
এই বিমানবন্দর অনেক আবেগের...  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘুরে সময় কাটাবার সুযোগ নেই। পর্যটন করপোরেশনের দোকানটিতে দেশের ঐতিহ্য যে কিছু উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনটিও নয়। রেস্টুরেন্ট আর স্ন্যাকসের দোকানে খাবারের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয় নয়।

শুক্রবার (২১ জুলাই) সন্ধ্যায় ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েই ইত্তেহাদের কর্মীদের হাঁক-ডাক শুনছিলাম। 'নয়ন তারা' নামে এক নারী যাত্রীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা।

ফ্লাইটের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, যাত্রীর হদিস নেই।  

চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছিলেন ওই নারী যাত্রী।                                         চেক-ইন কাউন্টারের সামনেও কোনো যাত্রী নেই বলে জানানো হয়েছে। ইত্তেহাদের একজন কর্মী রাগ করে বলেই ফেললেন, ‘সারা বছর আত্মীয়ের কোনো খোঁজ নেই, এখন সব উৎলাইয়া উঠছে। '

আমার ইমিগ্রেশন কমপ্লিট হলো আরও ১৫ মিনিট পর। এমন সময় দেখা গেলো লাউঞ্জের একেবারে দক্ষিণ দিক থেকে চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত এগিয়ে আসছেন বোরকা পড়া এক নারী। চোখের অনুমানে বয়স ৪০ হবে। চোখ মুছলেও কান্না থামে না।  

বিমানবন্দরে যাত্রীরাইত্তেহাদের কর্মীরা সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরলেন, ‘আপনাকে এতো মানুষ, এতোক্ষণ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর আপনে পিছে যাইয়া কাঁদছেন!'

কথা বলার শক্তি নেই নারীর। দ্রুত পথ চলতে থাকেন তিনি। এই শাহজালাল বিমানবন্দরে অনেক সাদা চামড়ার মানুষ চোখে পড়বে না। পশ্চিমা বিশ্বের কথা বাদ, দেশীয় ব্র্যান্ডের কোনো শপও চোখে পড়বে না। চোখ ভিজিয়ে দেবে এই বিমানবন্দরের আবেগমাখা চরিত্রগুলো।  

যেখানে মা তার শিশু সন্তানদের রেখে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন ভিনদেশীদের ঘরে কাজ করতে। অর্থ উপার্জন করে ঘরের মানুষগুলোকে ভালো রাখতে। নিজের সুখগুলোকে তেপান্তরের ওপারে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।  

যাত্রীদের স্বজনরাযাত্রী ছাড়া এখন ঢাকায় বিমানবন্দরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। বিমানবন্দরের মূল সড়কেই যাত্রীর সঙ্গীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষগুলো সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এরা দাঁড়িয়ে প্লেনের উড়ে যাওয়া দেখে...! ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন প্রবীণ বাবা-মা কিংবা অবুঝ ছেলে-মেয়েরা। অনেকেই সমালোচনা করেন, এখানে যাত্রীদের সঙ্গে এতো মানুষ আসে কেন? 

এখানে দেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ যাত্রীই শ্রমিক হিসেবে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাচ্ছেন। একজন যাত্রীর সঙ্গে একটি পরিবার, একটি গোষ্ঠী, অনেক জায়গা জমি, অনেক হাসি কান্না জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে অভাবের অতীত আর স্বচ্ছল ভবিষ্যতের স্বপ্নও। তাই সেই স্বপ্নের ডানা মেলা দেখতে চাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করাই যায়!

বিমানবন্দরের বাইরে বিদেশ যাত্রীদের স্বজনরা।  সাইফুর রহমান নামে একজন বেসসরকারি চাকুরে অফিসের কাজে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। বাংলানিউজের তিনি বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রীর সঙ্গীদের যতোটা সম্ভব বেশি সময় থাকতে দেয়াই উচিত। কারণ এই যাত্রীদের পাঠানো বিদেশি অর্থেই তো চলছে আমাদের অর্থনীতির চাকা।  

‘নিরাপত্তা মজবুত করে আর এয়ারপোর্টকে আরও বড় করে তাদের জীবন সঙ্গীর সঙ্গে আরও কয়েকটি মিনিট বেশি সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা তো রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ’ 

এখানে মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইটগুলোতে নারীদের দীর্ঘ লাইনে হাসি নেই। আকাশে ওড়ার সময় যতো কাছে আসে সন্তান আর স্বামীর কাছ থেকে ততো দূরে চলে যায় সে। নয়ন তারাদের কান্না থামে না সহজে।  

ইমিগ্রেশন শেষ হলেও ফোনে কথা শেষ হয় না, চলে প্লেনে কেবিন ক্রু মানা করা পর্যন্ত। ইমো বা হোয়াটস অ্যাপের মতো অ্যাপগুলোতেও ভেসে বেড়ায় মা, স্ত্রী, সন্তানদের মুখ। দুই পাশই কাঁদছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে গেলে ক্যামেরার সামনে থেকে চোখ সরিয়ে ফেলেন ছেলে।  

এই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনেক আবেগের সাক্ষী। এখানকার চকচকে ফ্লোরে অনেক সন্তান আর বাবা মায়ের চোখের পানি মিশে আছে বা মিশছে প্রতিনিয়ত...।  

'চলে যাচ্ছি, দোয়া করো, বাচ্চাদের দেখে রেখো,' এই শেষ কথা শোনা যায় অনেকবার।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
এমএন/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।