ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নিরাপত্তার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন শিল্পী বণিক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
নিরাপত্তার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন শিল্পী বণিক

বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ) থেকে: জেলার বাজিতপুরের একটি হিন্দু শহীদ পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বাড়িঘর দখলে নিতে একটি প্রভাবশালী মহল পরিবারটিকে দেশছাড়ার হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, হামলা ও নির্যাতনের পাশাপাশি শ্লীলতাহানি ও লুটপাট চালিয়েছে।

পরিবারের সদস্য স্থানীয় ‘সাপ্তাহিক ইছামতি’ পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক ও উন্নয়ন সংগঠন ‘সুহৃদ’-এর চেয়ারম্যান শিল্পী বণিক (৪৯) মামলা করেও নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না।

আসামিরা মামলার পরদিনই জামিনে খালাস পেয়ে অধিকতর হামলার ভয় দেখাচ্ছে।

সরকার দলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় চলছে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাটি।

কিশোরগঞ্জের মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক উদ্বেগ প্রকাশ করে বিষয়টি বাংলনিউজের নজরে আনেন।

বাংলানিউজকে শিল্পী বণিক বলেন, তাদের বাড়ি বাজিতপুর উপজেলা সদরের পূর্ব আলিয়াবাদ এলাকার পালাপাড়া গ্রামে। তার পিতামহ লাল মোহন বণিক একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হন। এখন তাদের পৈত্রিক বাড়ি থেকে পূর্ব বসন্তপুরের জাহেদ আলী ও জাহেদের ভায়রাভাই নোয়াহাটা গ্রামের এমাদ মিয়ারা ক্রমাগত হুমকি দিয়ে আসছেন। এরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন মাস্টার এবং  দীঘিরপাড় ইউপি চেয়ারম্যান আমিন মোহাম্মদ ফারুকের নিকটাত্মীয় পরিচয় দেন। এই সন্ত্রাসী চক্রের ফাঁদে পড়ে বাজিতপুরের অনেক হিন্দু পরিবার এলাকাছাড়া এবং দেশছাড়া বলেও তিনি তথ্য দেন।  

শিল্পী বণিকের ভাষ্যে জানা যায়, তার ছোটভাই স্বর্ণ ব্যবসায়ী উত্তম বণিকের (৪৬) সঙ্গে সুদখোর জাহেদের স্ত্রী সোনিয়া কৌশলে ভাই-বোন সম্পর্ক গড়ে তুলে উত্তমকে লাভের বিনিময়ে ৮ লাখ টাকা দেয়ার প্রলোভন দেখান। পরবর্তীতে উত্তমকে সোনিয়ার বাড়িতে নিয়ে একটি দলিলে অস্ত্রের মুখে স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করেন। স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে উত্তম বণিকের ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে রুদ্রমোহন বণিক উৎসকে অপহরণ ও গুম করার হুমকি দিয়ে স্বাক্ষর আদায় করেন।

গত ৯ এপ্রিল দুপুরে জাহেদ আলী (৪০), তার স্ত্রী সোনিয়া (৩২), এমাদ মিয়া (৪২) ও তার স্ত্রী তানিয়ার (৩৪) নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি দল দেশি অস্ত্র নিয়ে শিল্পী বণিকদের পৈত্রিক বাড়িতে হামলা চালায়। তারা বাড়ি ছাড়ার হুমকি দেয়, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে, শ্লীলতাহানি ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বসতঘরের সামনে-পেছনে গ্রিলে তালা লাগিয়ে গৃহবন্দী করে রাখে। এমনকি এমাদ মিয়া পরদিন গিয়ে বিদ্যুৎলাইন ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। খবর পেয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাবেক পৌর মেয়র মিজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ গিয়ে গ্রিলের তালা ভেঙে বিদ্যুৎ ও পানির লাইনের সংযোগ দিয়ে অসহায় শহীদ পরিবারটিকে উদ্ধার করেন।

এ ঘটনায় শিল্পী বণিক বাজিতপুর থানায় ডায়রি করতে গেলে তাকে পুনরায় থানার গেটেই প্রতিপক্ষ মারধর করে দেশছাড়া করে বাড়ি দখল করার হুমকি দেয়। শিল্পী বণিক সেখান থেকে ভয়ে পালিয়ে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৪৪ ধারা জারির আবেদন করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাজিতপুরের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিষয়টি তদন্ত করে ২২ মের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেন।

এদিকে গত ১৫ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে জাহেদ আলী, এমাদ ও সোনিয়াসহ তাদের লোকজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিল্পী বণিকদের বসতঘরে ঢুকে আসবাবপত্র ভাংচুর করে, শিল্পী বণিককে শ্লীলতাহানি করে। তার ছোটভাই উত্তম বণিককেও মারধর করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে। উত্তমের ছেলে উৎস ও তার মা ডলি বণিক এগিয়ে গেলে তাদেরও কিলঘুষি মারে, চুল ধরে টানাহেঁছড়া করে। এসময় শিল্পী বণিক সাবেক মেয়র মিজবাহউদ্দিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করার পর তিনি পুনরায় কয়েকজন লোক পাঠালে হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় শিল্পী বণিকের বাড়ির পত্রিকা কার্যালয় ভাংচুর করে এবং ল্যাপটপ, দুটি স্বর্ণের আংটি, একটি স্বর্ণের ব্রেসলেট, অফিসে রাখা ২২ হাজার টাকা ও তিনটি দামি মোবাইল সেট নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় পরদিন ১৬ জুলাই জাহেদ, এমাদ ও সোনিয়াসহ অজ্ঞাত ৭-৮ জনকে আসামি করে শিল্পী বণিক বাদী হয়ে বাজিতপুর থানায় মামলা করেছেন। মামলাটি দ-বিধির ১৪৩/৪৪৮/৩২৩/৩৮০/৩৫৪/৪২৭/৫০৬ ধারায় রেকর্ড করা হয়। তবে আসামিরা আদালত থেকে জামিনে গিয়ে  হুমকি দিচ্ছেন বলে শিল্পী বণিক জানিয়েছেন।

অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলার জন্য জাহেদ আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হন নি।

সর্বশেষ খবর হলো, বাজিতপুরের এই শহীদ হিন্দু পরিবারটি বেশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অসহায় শিল্পী বণিক বাড়িতে থাকতে পারছেন না। নিরাপত্তার জন্য তিনি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। স্থানীয় মানবাধিকার নেতা-কর্মীরা মনে করেন, দ্রুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা হলে নিরীহ পরিবারটি বিপজ্জনক হামলার সম্মুখীন হতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।