কালের পরিক্রমায় দেশের ঐতিহ্যবাহী অনেক শিল্প ও প্রত্ন নিদর্শন হারিয়ে গেলেও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি কুমিল্লার মৃৎশিল্প। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের জেলখানা বাড়ি এলাকার মৃৎশিল্প এখনও সারাদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
মাত্র ১৫০ টাকা আমানত সংগ্রহ করে “রুদ্রপাল সমবায় সমিতির”মাধ্যমে কার্যক্রমও শুরু করে দেন। ১৯৬২ সালে বিজয়পুর তথা কুমিল্লার মৃৎশিল্পীদের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক সংগঠন রুদ্র পাল সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রুদ্রপাল বংশের নামকরণে সমিতিটির নামকরণ করা হয়। সেই সময় কুমিল্লায় মৃৎশিল্প-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিলো ৬৪৪টি। মৃৎশিল্পে অভিজ্ঞতা ও উন্নতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ, শেয়ার ও আমানত বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন গঠন, শিল্পজাত দ্রব্যের সুষ্ঠু রাজারজাতকরণ এবং সর্বোপরি মৃৎশিল্পীদের বেকারত্বের সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে এ সমিতি গঠিত হয়।
এলাকার হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে প্রায় ২১০ টি পরিবারের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে এই শিল্পের মাধ্যমে। জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলাধীন দক্ষিণ বিজয়পুর, গাংকুল, টেগুরিয়াপাড়া, নোয়াপাড়া, বারপাড়া, উত্তর বিজয়পুর ও দুর্গাপুরসহ মোট ৭টি গ্রামের মৃৎশিল্পীগণ (কুমার) এ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছেন। শুরুর দিকে মাত্র ১৫ জন সদস্য সমন্বয়ে সমিতি গঠন করা হলেও পর্যায়ক্রমে সমিতির সদস্যসংখ্যা বেড়ে এখন ২০৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের ১৪৮ জন পুরুষ এবং ৬১ জন মহিলা।
এছাড়া মৃৎশিল্পজাত পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ কার্যক্রমে ৩ হাজার ২৪২ জন পুরুষ এবং ২ হাজার ৮২৬ জন মহিলাসহ মোট ৬ হাজার ৬৮ জন লোক জড়িত। এ এলাকায় বসবাসকারী ৭০০ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। এলাকায় মৃৎশিল্প উৎপাদনকারীদের বেকারত্ব দূরীকরণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে আসছে।
এখানে প্রায় তিন হাজার রকমের মৃৎপণ্য বা মাটির জিনিস তৈরি করা হয়। এগুলোর মধ্যে হাঁড়ি,পাতিল,বাটি ,বদনা, মটকা, প্রদীপ, ছাইদানি, গেলাস, সানকি, ঘড়া, কল্কি, গামলা,জলাবিড়া,জটধুসি, জলকান্দা, চুনপাত্র, সরাই, দুধের হাড়ি, ফুলদানী, মালসা, থালা, পানের বাটা, খেলনা, কলস, মুবঘট,লক্ষ্মীঘট, আয়োঘট,পুজার ঘট, দোয়াত বৈয়াম, লক্ষ্মীর সড়া, মটকা, কাজলবাটি নাদা, তবলার বায়া, মৃদংগ নাল, পাখোয়াজের মাটির খোলসহ অসংখ্য রকমের দৃষ্টিনন্দন জিনিসপত্র রয়েছে।
বিজয়পুরের মৃৎর্শিল্পীদের তৈরি নান্দনিক ও রুচিসম্পন্ন পেট্রেট ঘর সাজানোর আধুনিক ধারার কারুকার্য খচিত সরঞ্জামাদি বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে । এখানে উৎপাদিত মাটির জিনিসপত্র ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনাসহ প্রায় ৩৪টি জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এ মৃৎপণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও বেশ সমাদৃত। এখানকার উৎপাদিত পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, জাপান, হল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধি দল, ইংল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাসহ বিদেশি ব্যক্তিবর্গ এখানে বেড়াতে বা সফরে এসে এখানকার উৎপাদিত পণ্য দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে গেছেন।
রুদ্রপাল সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি রতনচন্দ্র পাল বলেন, জেলার কুমারেরা চাক ঘুরিয়ে মাটিকে দিচ্ছে শিল্পকর্মের আদল। মাটির এক টুকরো পিণ্ড থেকে তৈরি হচ্ছে নয়নশোভন মৃৎপাত্র। সেই পাত্রে আঙুলের সুনিপুণ চাপ দিয়ে এখানকার মৃৎশিল্পীরা নকশা কেটে সৃষ্টি করছেন নানা বাহারি পণ্য। চারু ও কারুতায় স্বাক্ষর রাখছেন নিজেদের শিল্প-প্রতিভার। ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটিকে মানসম্মতভাবে বাঁচিয়ে ও টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা সবাই মিলে। এই মৃশিল্প আমাদের আহার যেমন যোগাচ্ছে, তেমনি দিচ্ছে নিজেদের সৃজনশীলতা তুলে ধরবার বিরল সুযোগ।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
জেএম/