ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

লাল মাকড়সা, মশা ও বিরূপতায় চা-শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
লাল মাকড়সা, মশা ও বিরূপতায় চা-শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা লাল মাকড়সা, মশা ও বিরূপতায় চা-শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা

মৌলভীবাজার: বিরূপ আবহাওয়ার কারণে চা-শিল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চা উৎপাদনের এই অনুকূল মৌসুম এই ভরা বর্ষায়ও চা গাছসমূহে রেড স্পাইডার (লাল মাকড়) ও মশার (হেলোপনটিস)আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এর ফলে কীটনশাক ব্যবহারের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। এতে পরিবেশের অধিকতর ক্ষতি হচ্ছে। চায়ের উৎপাদনে এর প্রভাব পড়তে পারে। সংশ্লিষ্টরা এমনটাই আশঙ্কা করছেন।

তাছাড়া চা-বাগানসমূহে শেড ট্রি না থাকা বা ব্যাপক হারে কমে যাওয়াও উৎপাদন হ্রাসের অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। গত বছরের তুলনায় এবছর অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হওয়ার কারণেও ফলন কম হতে পারে।

চায়ের জন্য অতিবৃষ্টি যেমন ক্ষতিকর, তেমনি কম বৃষ্টিও ক্ষতিকর। অতিবৃষ্টি ও লাল মাকড়সা ও মশার কারণে এবছর ১৫ ভাগ ফলন কম হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন কর্তৃপক্ষ।

দেশে মোট ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট ও হবিগঞ্জে রয়েছে ১৪৫টি এবং চট্রগ্রামে রয়েছে ২২টি। সব বাগানে একই চিত্র। বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার সবক’টি বাগান ঘুরে এচিত্রই দেখা গেছে।

মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ফল বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কোথাও খরার প্রকোপ আবার কোথাও অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে চা বাগানগুলোতে উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে।
অন্যদিকে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানে চা-গাছ বিনষ্ট ও টিলা ধসের ঘটনা ঘটেছে।
লাল মাকড়সা, মশা ও বিরূপতায় চা-শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা
চা বাগান ও বনাঞ্চল অধ্যুষিত সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি টানা বৃষ্টিপাতে কোনো কোনো স্থানে চা-গাছের জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। আবার কোনো কোনো স্থানে খরা ও বৃষ্টিহীনতার কারণেও বিরূপতার শিকার চা-বাগানগুলো।

মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা-বাগানের প্লান্টেশন এলাকায় চা-গাছে লাল মাকড়শা(রেড স্পাইডার) ও মশার(হেলোপেনটিস) আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এতে করে চা গাছগুলো বিবর্ণ হয়ে পাতা কুঁকড়ে গেছে। বাগানগুলোর সেক্শনের পর সেক্শনে দেখা দিয়েছে এই রোগ। চা-গাছগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে, কচি পাতাগুলোর রস খেয়ে ছিদ্র করে দিচ্ছে। এছাড়া অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, প্রখর রোদ, কাঁচি দিয়ে চা গাছ থেকে পাতা তোলা, চা বাগানের সেক্শনগুলোতে গরু ও ছাগল চরানো—এসবের কারণে চায়ের ফলন কমে যায়।

বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কীট-পতঙ্গের আক্রমণ বাড়ে। আর কীট-পতঙ্গ দমনের জন্য অত্যধিক পরিমাণে প্রতিষেধক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। তবু পুরোপুরি বালাই দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং বলাইনাশক বা কীটনাশক এসব কীট পতঙ্গের গা সহা হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় লাল মাকড়সা, মশা ও কীট পতঙ্গ দমন করতে নিমের রস ও মেহগনির রস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কাউডাং(গোবর) সার ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অধিক মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা কমে গিয়ে ফলন হ্রাস পাচ্ছে এবং মাটির গুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিসের সিনিওর অবজারভেটর(এসও) হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন গত বছর গড় বৃষ্টিপাত ছিল ১৪৭১ মিলিমিটার এবং এ বছর এপর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাত ২৩০৫ মি.মি.। যা গত বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত ৮৩৪ মিলিমিটার বেশি। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে মশার উপদ্রবও বেড়েছে অনেক। ঝাঁকে ঝাঁকে মশা একেকটি সেক্শনে বসে চায়ের কচি পাতার রস খেয়ে ফেলাতে চা গাছ কুঁকড়ে যায় এবং লাল মশার কারণেও সমস্ত সেক্শনে লাল হয়ে চা-পাতা মরে যাচ্ছে। এতে করে ফলন কমে যাচ্ছে। অনেক সময় শ্রমিকের হাজিরার নিরিখও পূর্ণ হচ্ছে না।

প্রতিটি চা বাগানের প্রতি একরে মোট ৬ হাজার ৭শত টি চা গাছ লাগানো হয়ে থাকে। আর এসব সৃজনকৃত জায়গায় গড়ে ৩শত থেকে সাড়ে ৩শত শেড ট্রি(ছায়াবৃক্ষ) লাগানোর কথা। অর্থাৎ প্রতি একরে ৬৫ ভাগ ছায়াবৃক্ষ থাকার কথা থাকলেও কোনও কোনও বাগানে ২০ ভাগও ছায়াবৃক্ষ নেই। এতে করে প্রচুর ফলন কম হচ্ছে এবং চায়ের মানও ভাল হচ্ছেনা। যেসব বাগানে পর্যাপ্ত ছায়াবৃক্ষ রয়েছে সেসব বাগানে ভাল মানের চা উৎপাদন হচ্ছে।

হামিদিয়া টি এস্টেটের ম্যানেজার মো:সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ধারাবাহিক বৃষ্টিপাতের ফলে চা-বাগানের উপরিভাগের মাটি ক্ষয়ে গিয়ে মাটির উর্বরতা কমে যায়। সাম্প্রতিক সময়ের ধারাবাহিক টানা বৃষ্টিপাত চা-গাছের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনছে। এই অনুকূল আবহাওয়ার সময়েও রেড স্পাইডার ও মশার আক্রমণ দেখা দিয়েছে।


তিনি আরও বলেন, এগুলোর হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। ফলে খরচের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া চুরি ও অন্যান্য কারণে চা-বাগান থেকে ছায়াবৃক্ষ বা শেড-ট্রি অত্যধিক পরিমাণে কমে যাওয়াও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
চা বাগানের প্লান্টেশন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লাল মাকড়শা’র আক্রমণে কিছু কিছু বাগানে চা গাছের পাতা লাল রং ধারণ করেছে। আর অত্যধিক পরিমাণে মশার আক্রমণে অনেক চা গাছের পাতা কালো রং ধারন করেছে এবং কুকড়ে গিয়ে মরে যাচ্ছে।

চা শ্রমিক, শ্রমিক সর্দার ও চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির লোকজন জানান, মশায় ও লাল মাকড়সায় আক্রান্ত চায়ের এসব লাল পাতা চা উৎপাদনে কোনো কাজে আসবে না।   এসব কারণে শ্রমিকদের নিরিকও (মজুরিও) ঠিকমতো হয় না। এবছর বিরূপ আবহাওয়ায় প্রখর রোদের সময় চা গাছগুলোতে রেড স্পাইডার ও মশার আক্রমণ বেড়ে গেছে। চা গাছের এই আক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কীটনাশক প্রয়োগ করলে আকস্মিক বৃষ্টির ফলে এই কীটনাশকের কার্যকারিতাও থাকে না। ফলে  প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। চা বাগানগুলোতে এসব কীটনাশকও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

চা বাগান প্রহরী সৎ নারায়ণ বলেন, চা সেক্শনের ভিতরে গরু ও ছাগল প্রবেশ করলে লাল বেমারের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন গরু ও ছাগলের লেজের মধ্যে এক ধরনের পোকা বসে থাকে আর এগুলো গরুর লেজ থেকে চা গাছের কচি পাতায় ছড়ায় এবং চা পাতাগুলো নষ্ট করে ফেলে। রোদের সময় এরোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি হয়।

লাল মাকড়সা, মশা ও বিরূপতায় চা-শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা

চা সর্দার হারাধন বাউরী বলেন, দিনে রোদ থেকে বাঁচতে মশাগুলো গাছের ছায়ায় অবস্থান নেয়। বৃষ্টি ও বিকেলের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা কচি পাতার উপর বসে রসটা শুষে নেয়। এতে করে পাতাগুলো কালচে আকার ধারণ করে গুটিয়ে যায়। কোনও কোনও কচি পাতার নীচে মশা ডিম পাড়ে।

চা শ্রমিকনেতা সিতারাম বীণ বাংলানিউজকে বলেন, লাল বেমারীর জন্যে শ্রমিকদের হাজিরা তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সাধারণ চারাগাছ থেকে ২০ কেজি ও কলম চারা গাছ থেকে ১৬ কেজি করে পাতা তুলতে হয় হাজিরার জন্য। কিন্তু প্রকট আকারে লাল বেমারী হওয়াতে সে নিরিখ (মজুরি) পুরো করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষণাকেন্দ্র (বিটিআরআই)-র পরিচালক ড.মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে সবকিছুর পরিবর্তন ঘটছে। রোগব্যাধি ও বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড়ের আক্রমণ বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, গত বছর দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি। এবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১০ মিলিয়ন কেজি। কিন্তু আবহাওয়ার এই বিরূপ অবস্থায় এবং বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে তা ব্যাহত হতে পারে।

পরিবেশবাদী সাংবাদিক নুরুল মোহাইমিন মিল্টন বাংলানিউজকে বলেন, পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য চা-বাগানে যে পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় সেগুলো পানিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জলজ পরিবেশেরও ক্ষতি বয়ে আনছে। এগুলো পানিতে মিশে যাওয়ায় বিভিন্ন প্রকার মাছ,পরিবেশের জন্য উপকারী কীট প্রতঙ্গ ও সাপ মরে যাচ্ছে। ব্যাপক হারে কীটনাশক প্রয়োগ না করে এর বিকল্প খোঁজা উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ০০২১ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।