ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বাসে জিম্মি, নৌ-পথে ভোগান্তিতে মুন্সীগঞ্জবাসী

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
বাসে জিম্মি, নৌ-পথে ভোগান্তিতে মুন্সীগঞ্জবাসী মুন্সীগঞ্জ রুটের বাস ও লঞ্চ সার্ভিস; ছবি-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। এতো কাছের জেলা হয়েও ভালো বাস সার্ভিস ও সরাসরি কোনো নৌ-যান চলাচল না করায় দুর্ভোগে পড়ছেন জেলাবাসী।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ জীবিকার তাগিদে রাজধানীর ওপর নির্ভরশীল।

দিঘীড়পাড় ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের বাস ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কপথে চলাচলের একমাত্র সার্ভিস।

আরেকটি সার্ভিস ‘কুসুমপুর’ থাকলেও কয়েকটি বাস এবং প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আস্থা নেই যাত্রীদের। এ রুটে বিআরটিসি চালু হলেও তা এখন বন্ধ।

নৌ-পথে লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ বন্দর ঘাট নেমে বাস কিংবা ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়। বিরুপ আবহাওয়া, ডাকাতি, দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে যাতায়াত করতে হয় যাত্রীদের। ঢাকার সদরঘাট যেতে মাঝ নদীতে ট্রলারে উঠতে হয়।

বিআরটিএ’র ২০১৩ সালের প্রজ্ঞাপন অনুসারে কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া ১ টাকা ৪০ পয়সা (টোল, ফেরি থাকলে), স্বাভাবিক ভাড়া ১ টাকা ০৭ পয়সা। সে অনুসারে এ রুটের সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা ৪০ টাকা। কিন্তু দিঘীড়পাড় ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড নিচ্ছে যাত্রীপ্রতি ৬০ টাকা।

যাত্রীদের অভিযোগ, শহরের লিচুতলা কাউন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে দিঘীড়পাড়। বাসের সব সিটে যাত্রী না বসা পর্যন্ত ছাড়ে না। অতিরিক্ত যাত্রীও ওঠানো হয়। প্রতিবাদ জানালে ‘বাস কিন্তু সামনে আর যাবে না’ বলে হুমকি দেন ড্রাইভার ও সহকারী।

দিঘীড়পাড়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) নূর হোসেন ব্যাপারি বলেন, ‘ঢাকা রুটে আমাদের ৫২টি বাস চলাচল করে। জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় ৬০ টাকা ভাড়া ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এটি ঠিক যে, মুন্সীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের দূরত্ব। কিন্তু আমাদের লিচুতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে গুলিস্তান (ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ সংলগ্ন) পর্যন্ত দূরত্ব হয় ৩৩ কিলোমিটার’।

সরকারি নিয়মে ৩১টি সিট থাকার কথা থাকলেও দিঘিরপাড় বাস সার্ভিসে রয়েছে ৩৩টি। এর সপক্ষে তার দাবি, বাসের সঙ্গে স্টাফ-পুলিশসহ অনেকেই ফ্রি যাতায়াত করেন।

প্রায়ই যাতায়াতকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এস এম আলী আজগর বলেন, ‘এ বাস সার্ভিসের কারণে আমাদের জেলার সুনাম কমছে। এ রুটে রাত ১০টার পর যাতায়াত করলে চুরি-ছিনতাইয়ের ভয় থাকে। অথচ রাত ৯টা ২০ মিনিটের পর কোনো লঞ্চ চলাচল করে না নৌ-রুটে। নারায়ণগঞ্জের লঞ্চে চাষাড়া নামলে লেগুনা কিংবা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় অতিরিক্ত যাত্রী ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। ঝামেলা এড়াতে তাই এ বাস দিয়ে যাতায়াতের বিকল্প পথ থাকে না’।

ব্যবসায়ী জীবন ব্যাপারি বলেন, ‘আমাকে প্রত্যেক দিন ঢাকা যাতায়াত করতে হয়। ভোর ৬টা ২০ মিনিট থেকে রাত ৯টা ২০ মিনিট পর্যন্ত মোট ১৫ ঘণ্টা চালু থাকলেও বৈরি আবহাওয়ায় লঞ্চ বন্ধ হলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না’।

দিঘীড়পাড় বাস সার্ভিস বছর বছর ভাড়া বাড়ালেও যাত্রীসেবা বাড়ায়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সিটিং সার্ভিসের নামে নির্ধারিত ভাড়ার দেড়গুণ আদায় করা হচ্ছে। তাদের প্রতারণা দেখার যেন কেউ নেই’।

গত ১৭ জুন দিঘীড়পাড় ট্রান্সপোর্টকে চার লাখ টাকা জরিমানা ও আটটি বাস জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু আগের মতোই ৬০ টাকা ভাড়া আদায় চলছে। ঈদের সময় ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে দিঘীড়পাড়ের মালিক জগলুল হালদার ভুতু জানান, ‘আমরা সেবার মান বাড়িয়েই চলেছি। এতো বড় সার্ভিস, সেবার মান বাড়ালে ভাড়া তো বেশি দিতে হবেই। বিআরটিসি বাস সার্ভিস তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে চলে গেছে, এখানে আমাদের কোনো হাত নেই’।

মুন্সীগঞ্জ রুট শ্রমিক সমিতির সভাপতি নুরুল কাদের নুরু বলেন, বিআরটিসি বাসে কম সংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করতেন। ওই বাস আনতে যে রাজস্ব দিতে হয়, তা দিয়ে পোষাতে পারে না। এ সার্ভিস যে জেলায় চলে, চুক্তিবদ্ধ কিংবা লিজ নিয়ে চলাচল করে। বাসগুলো নির্ধারিত টাকা পরিশোধ করতে পারেনি বলে তারাই বন্ধ করে দেয়।

তবে যাত্রীদের অভিযোগ, দিঘীড়পাড় বাস সার্ভিস সিন্ডিকেটের লোকজন গুলিস্তানে বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড বসতে দেন না। এজন্য পুলিশের সঙ্গে মোটা অংকের টাকা বিনিময় করে সিন্ডিকেটটি। দিঘীড়পাড়ের মালিক ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর একক ব্যবসা করতে কোনো বাস সার্ভিসকে এখানে আসতে দেন না’।

কনজ্যুমারস্‌ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জেলা শাখার সভাপতি জাহাঙ্গীর সরকার মন্টু জানান, দিঘীড়পাড়ে ২৮ টাকার ভাড়া ৩৫ থেকে এখন ৬০ টাকা করা হয়েছে। আগে গাড়িতে ফ্যান ছিল, এখন নেই, সবগুলো নষ্ট। বিআরটিসির বাসগুলো ছাড়তে দীর্ঘ সময় লাগে, স্ট্যান্ড নিয়েও সমস্যা। মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ রুটের লঞ্চগুলোতে প্রায়ই ডাকাতি ও বল্গহেট-ড্রেজারের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। ভাড়াও দূরত্বের তুলনায় অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকা যাওয়ার দু’টি মাধ্যমেরই খারাপ অবস্থা’।

বিআরটিসি বাস সার্ভিসের (মতিঝিল ডিপো) ম্যানেজার মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা ছিল না। স্থানীয় সড়ক পরিবহন কমিটি আমাদের বাস চলতে আপত্তি ও নানা প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে। গুলিস্তানে আমাদের কাউন্টার বসতে না দেওয়া ও দিঘীড়পাড় বাস সার্ভিসের লোকজনের যোগসূত্র থাকায় আমরা চলে আসতে বাধ্য হই’।

হাট লক্ষীগঞ্জের দোকানদার আলাউদ্দিন হোসেনের অভিযোগ, মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌ-রুটের বেশিরভাগই লঞ্চই ফিটনেসবিহীন। ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে লাইসেন্সবিহীন অনেক লঞ্চ চলাচল করে। জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট, অগ্নি নির্বাপকের কোনো ব্যবস্থাও নেই। এক বছর আগে ঢাকার সদরঘাটের সঙ্গে স্পিডবোট চালু হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাঁদা দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় সার্ভিসটি।  

লঞ্চ মালিক সমিতির সদস্য ও মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটের ইজারাদার দিল মোহাম্মদ কোম্পানি বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌ-রুটে আমাদের ২২টি লঞ্চ চলাচল করে। সবগুলোরই কাগজপত্র আছে ও বৈধ। সদরঘাটের সঙ্গে সরাসরি কোনো লঞ্চ মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে ছাড়ে না। গ্রিন ওয়াটার সকাল ১১টার দিকে আসে, ১টা ১২ মিনিটে বোগদাদিয়া, বিকেল ৩টার দিকে দামুদিয়া ঘাটে ভেড়ে। মাত্র ৪টি বড় লঞ্চ ভেড়ে, যা খুবই দুঃখজনক’।

জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা জানান, দিঘীড়পাড় বাস সার্ভিসকে ৬০ টাকা ভাড়া নিতে নিষেধ করা হয়েছে। জেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংয়ে ভাড়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছে। বিআরটিসি বাস ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ে। কিন্তু ৬০-৭০টি সিটে ওই সময়ে যাত্রী হন মাত্র ৩-৪ জন। ফলে তাদের ঢাকা যাওয়া-আসার খরচে পোষায় না’।

‘আমরা বাস যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করতে কাজ করছি। লঞ্চ মালিক সমিতিকেও যাত্রীসেবা বাড়াতে বলেছি, তারা সে অনুসারে কাজ করছে’।

বাংলাদেশ সময়: ০১২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।